হঠাৎ বৃষ্টি। সোমবার, চৌরঙ্গি এলাকায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ধর্মতলার মোড়ে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর তিরিশের তিন যুবক। হঠাৎ গায়ে কয়েক ফোঁটা জল পড়ল। বৃষ্টি নামছে আঁচ করে দৌড়নোর আগেই মুষলধারা বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলেন তাঁরা।
ওই সময়েই কলকাতার দিকে নামছিল একটি বিমান। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) অফিসার সেই বিমানের পাইলটকে নামার অনুমতি দিলেন না। জ্বালানি কম থাকায় বিমানের মুখ ঘুরিয়ে রাঁচিতে চলে গেলেন সেই পাইলট।
দু’টি ঘটনার ক্ষেত্রেই সৌজন্যে সোমবার ভরসন্ধ্যার আবহাওয়া!
এ দিন বিকেলে হাওয়া অফিস জানিয়েছিল, কলকাতা এবং লাগোয়া জেলাগুলির দিকে ধেয়ে আসছে ঝড়বৃষ্টি। খাস কলকাতায় অবশ্য এ দিন তেমন ঝড় মেলেনি। মিলেছে প্রবল বৃষ্টি। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, কলকাতায় ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
তবে হাওয়া অফিসের সূত্র বলছে, কলকাতার লাগোয়া এলাকাগুলিতে ঝোড়ো হাওয়া মালুম হয়েছে। জোরালো বৃষ্টির জেরে রাতে কমে গিয়েছিল তাপমাত্রাও। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, এ দিন সন্ধ্যায় প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য বিমান চলাচলেও ব্যাঘাত ঘটেছে।
আবহবিদেরা বলছেন, মার্চ মাস থেকেই ঝাড়খণ্ড-বিহারের পাথুরে মাটি গরম হতে শুরু করে। সেই হাওয়া গরম হয়ে গেলে বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তরে উঠলে ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি করে। সেই বজ্রগর্ভ মেঘই দক্ষিণবঙ্গে বয়ে আসে। ক্রমাগত বহরে বাড়তে থাকে। এক সময়ে বিরাট আকারের সেই মেঘ ভেঙে যায়। তা থেকেই চৈত্র-বৈশাখের সন্ধ্যায় আছড়ে পড়ে ঝড়বৃষ্টি। সেই ঝড়বৃষ্টি একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পেরোলে বলা হয় ‘কালবৈশাখী’।
এ বছর অবশ্য উত্তর ভারতে শীতের প্রভাব না কাটায় বিহার-ঝাড়খণ্ডের মালভূমি এলাকাতেও তাপমাত্রা বাড়তে পারছিল না। যার ফলে ঝ়ড়বৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারছিল না। কিন্তু সেই ছবিটা বদলে দেয় একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা।
আলিপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, দিন কয়েক আগে পূর্ব ভারতে নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হওয়ায় বিহার-ঝাড়খণ্ডের পরিমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের আধিক্য বেড়েছিল। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় সেই জলীয় বাষ্পপূর্ণ হাওয়া গরম হয়ে বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তরে ওঠে। তা থেকেই তৈরি হয়েছিল বজ্রগর্ভ মেঘ। আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলছেন, ‘‘ঝাড়খণ্ড-বাংলা সীমানায় এ দিন একাধিক বজ্রগর্ভ মেঘপুঞ্জ তৈরি হয়েছিল। সেগুলি একে অন্যটির সঙ্গে জুড়ে বিরাট আকারের মেঘ তৈরি করেছিল। মেঘটির উচ্চতা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১২ কিলোমিটার!’’
এমন বড় মাপের মেঘ তৈরি হলে এ দিন কলকাতার কপালে কালবৈশাখী জুটল না কেন?
আবহবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা: বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানা থেকে মেঘটি কলকাতায় আসার সময় বর্ধমান, বীরভূম, হুগলি, হাওড়ার মতো দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলার উপর দিয়ে এসেছে। তার ফলে সেখানে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। সেই ঝড়বৃষ্টি কিছুটা হলেও মেঘের শক্তি কমিয়েছিল। তাই কলকাতায় এ দিন বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বইলেও ঝড় মেলেনি।
সেই দমকা হাওয়ার জেরেই অবশ্য আধ ঘণ্টা বিমান পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। এটিসি সূত্রের খবর, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আবহাওয়া খারাপ হতে থাকে। সেই পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কলকাতার দিকে এগিয়ে আসা বিমানগুলিকে চক্কর কাটতে বলা হবে। একের পর এক বিমানের পাইলটকে তেমন নির্দেশও পাঠানো হতে থাকে। জ্বালানি কম থাকায় দিল্লি থেকে আসা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান এবং নাগপুর থেকে আসা ইন্ডিগোর বিমান চলে যায় রাঁচিতে। এ ছাড়াও বেঙ্গালুরু থেকে আসা ইন্ডিগোর একটি বিমান চলে যায় ভুবনেশ্বর। একই কারণে দুবাই থেকে আসা এমিরেট্স-এর বিমানকে হায়দরাবাদে এবং আবু ধাবি থেকে আসা এতিহাদের বিমানকে ঢাকা চলে যেতে হয়। কলকাতা বিমানবন্দরের জিএম (এটিএম) চন্দন সেন জানান, প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির পাশাপাশি আকাশ বজ্রগর্ভ মেঘে ঢেকে থাকায় বিমানগুলি কলকাতায় আসতে পারছিল না। আটটার পরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। এর পরে অন্যত্র চলে যাওয়া বিমানের কয়েকটি যাত্রী-সহ কলকাতায় ফিের আসে। দিন সকালে বৃষ্টির জন্য কাঠমান্ডু বিমানবন্দরেও দু’ঘণ্টা বিমান পরিষেবা ব্যাহত হয়েছিল।
আবহবিদদের একাংশ বলছেন, সন্ধ্যার বৃষ্টির জেরে রাতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় আজ, মঙ্গলবার দিনের আবহাওয়ায় তার প্রভাব পড়বে। রোদ উঠলেও তাপমাত্রার পারদ খুব বেশি বাড়বে না বলেই তাঁরা মনে করছেন।