রোয়িং প্রশিক্ষকের লেখা সেই চিঠির প্রতিলিপি।
প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রবীন্দ্র সরোবরে রোয়িং করতে নেমে দুই কিশোরের ডুবে মৃত্যুর ঘটনার সময়ে সেখানে ছিলেনই না তাদের প্রশিক্ষক। ফলে প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা বুঝিয়ে ওই দুই ছাত্রকে জল থেকে তুলে আনার কাজটাই কেউ করেননি। ঘটনার এক মাসের মাথায় তদন্তে এমনই তথ্য উঠে এসেছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। ওই প্রশিক্ষক নিজেই দায় স্বীকার করে এক মৃত কিশোরের পরিবারকে চিঠি লিখে এই কথা জানিয়েছেন। সেই চিঠি পৌঁছেছে লালবাজারে। মামলার চার্জশিটে বিষয়টি রাখা হতে পারে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। আপাতত ওই প্রশিক্ষককে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশের দাবি, গত এক মাসে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রায় সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আলাদা করে কথা বলা হয়েছে বেঁচে ফেরা ছাত্রদের সঙ্গেও। তাতেই জানা গিয়েছে, পূষন সাধুখাঁ ও সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায় নামে দুই কিশোর যে নৌকায় ছিল, ঝড়ের সময়ে সেটি ছেড়ে সাঁতার কেটে তাদের পাড়ের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই নৌকার ‘কক্স’ (নৌকার মাঝামাঝি বসা মূল নির্দেশক)। বছর ২০-র ওই তরুণ অবশ্য নিজে সাঁতার কাটেননি। কেন? সে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে।
গত সোমবার লালবাজারে পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মৃত এক কিশোরের বাবা। সেখানে তিনি ওই প্রশিক্ষকের চিঠি লেখার কথাটা জানিয়েছেন। তা থেকেই পুলিশ নিশ্চিত হয়, ঘটনার সময়ে কোনও প্রশিক্ষক বা সেই স্তরের কেউ ছিলেন না।
উল্লেখ্য, গত ২১ মে সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রবীন্দ্র সরোবরে রোয়িং অনুশীলন চলাকালীন ডুবে মৃত্যু হয় সাউথ পয়েন্ট স্কুলের দুই ছাত্র পূষন ও সৌরদীপের। আন্তঃস্কুল রোয়িং প্রতিযোগিতায় ওই দিনই তারা সেমিফাইনালে জিতেছিল। পরের দিন ছিল ফাইনাল। তার আগে লেক ক্লাবের নৌকা নিয়ে অতিরিক্ত অনুশীলন করতে নেমে ঘটে ওই অঘটন। এর পরেই গাফিলতির একাধিক অভিযোগ ওঠে সরোবরে রোয়িংয়ের সঙ্গে যুক্ত ক্লাবগুলির বিরুদ্ধে। প্রশ্ন ওঠে, কেন অনুশীলন চলাকালীন কোনও উদ্ধারকারী নৌকা ছিল না? প্রশিক্ষক বা সেই পর্যায়ের কেউ ছিলেন কি না, দেখা দেয় সেই প্রশ্নও। দুই কিশোরের অভিভাবকদের জিজ্ঞাস্য ছিল, যদি প্রশিক্ষক থাকবেন, তা হলে তিনি কেন ঝড়বৃষ্টি দেখে নৌকা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন না? খারাপ আবহাওয়ার পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও কেন সতর্কতা নেওয়া যায়নি, সেই প্রশ্নের পাশাপাশি প্রশ্ন রয়েছে রোয়িং করতে নামা ছাত্রদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছিল কি না, তা নিয়েও। মৃত এক কিশোরের পরিবার আবার অভিযোগ করে, দুই কিশোরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা জানানোর বহু ক্ষণ পরে ডুবুরি নামানো হয়। যেখানে ওই পরিস্থিতিতে নৌকা ধরে ভেসে থাকাই বাঁচার পথ, সেখানে কার নির্দেশে দুই কিশোর সাঁতার কাটতে গেল, তাদের সেই নির্দেশ দেওয়াই বা হল কেন— এমন একাধিক প্রশ্ন ওঠে।
২১ তারিখই রাতে ঘটনাস্থলে যান মেয়র ফিরহাদ হাকিম এবং কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েল। পরবর্তী কালে নিরাপত্তার ‘ফাঁক’ বন্ধ করতে সরোবরে রোয়িং অনুশীলন করানো সব ক’টি ক্লাব এবং কেএমডিএ-কে নিয়ে বৈঠকে বসে লালবাজার। সেখানে একাধিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। লালবাজার এবং কেএমডিএ-র তরফে ক্লাবগুলিকে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর (এসওপি) পাঠানো হয়। এরই মধ্যে সৌরদীপের বাবা সৌভিক চট্টোপাধ্যায় একাধিক গাফিলতির কথা উল্লেখ করে পুলিশে লিখিত অভিযোগ করেন। তার ভিত্তিতে এফআইআর রুজু করে তদন্তে নামে লালবাজার।
পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘প্রশিক্ষক ওই চিঠিতে লিখেছেন, সাউথ পয়েন্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ বা স্কুলের ক্রীড়া বিভাগের কেউ ওই ঘটনার জন্য দায়ী নন। যদি কেউ দায়ী হন, তা হলে সেটা তিনি। ঘটনার দিন তিনি সেখানে ছিলেন না। প্রশিক্ষকের আরও দাবি, তিনি থাকলে দুই ছাত্রকে দ্বিতীয় বার জলে নামতে দিতেন না। কেন ওই প্রশিক্ষক ছিলেন না, তিনি কর্তব্যে এমন গাফিলতি কী ভাবে করলেন, সেটাই জানতে চাওয়া হবে।’’ সৌরদীপের মা যদিও এ দিন বললেন, ‘‘এক মাস পূর্ণ হতে চললেও সে ভাবে তো কিছুই হল না। যাঁদের গাফিলতি রয়েছে, পুলিশ তাঁদের খুঁজে বার করুক। আমরা দ্রুত বিচার চাইছি।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।