প্রতীকী ছবি।
শ্বশুরবাড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিলেন মহিলা। কিন্তু কোনও ভাবেই বিচার মিলছিল না। মাসখানেক ধরে থানায় ঘুরে শেষে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ওই মহিলা। এর পরে বিষয়টি আদালতে গেলে সেখানে নির্যাতিতা দাবি করেন, যত বারই তিনি মহিলা থানায় গিয়েছেন, তাঁকে বলা হয়েছে, ‘‘স্যরেরা ব্যস্ত। অন্য কোনও দিন ফোন করে আসুন।’’ কিন্তু ফোন করেও অভিযোগ জানানোর সুযোগ মেলেনি।
কিন্তু স্যর কেন? অভিযোগকারিণী তো গিয়েছিলেন মহিলা থানায়! কোর্টে নির্যাতিতার দাবি, মধ্য কলকাতার একটি থানার লাগোয়া ওই মহিলা থানাটি। সেখানে অভিযোগ নিয়ে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিলা পুলিশকর্মীকে ফোন করতে হত পাশের থানায়। সেখান থেকে কোনও পুরুষ পুলিশকর্মী এসে সমস্যার কথা শুনতেন। আর যে দিন এ ভাবে এসে অভিযোগ শোনার সময় নেই কারও, সে দিন সাফ বলা হত যে, অন্য দিন আসুন! এ যেন এক ‘অলিখিত নিয়ম’— গুরুতর অভিযোগ এলেই মহিলা থানা নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, ডাকতে হবে নিকটবর্তী থানার কোনও পুলিশকর্মীকে! নিতে হবে ‘স্যরেদের পরামর্শ’।
বছরকয়েক আগের এই অভিযোগে তোলপাড় হয়েছিল নানা মহলে। তবে এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মহিলা থানার বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির এমন অভিযোগ রয়েছে প্রচুর। বহু ক্ষেত্রেই সামনে এসেছে মহিলা থানার স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে না-পারার প্রসঙ্গ। এ নিয়ে বাহিনীর মধ্যেও অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ, দিনকয়েক তা নিয়ে শোরগোল চললেও পরে আবার যে কে সে-ই। বর্তমানে বারাসতের মহিলা থানা ধর্ষণের অভিযোগ নিতে চায়নি বলে অভিযোগ ওঠায় ফের এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যা প্রশ্ন তুলেছে— এ ক্ষেত্রেও কি মহিলা থানা কারও অধীনতায় বশ মেনে কাজ করেছে? স্বাধীন সিদ্ধান্ত কি নিতে পারেন না মহিলা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক? কেস নথিভুক্তির বদলে অত্যাচারিত মেয়ে-পক্ষকে ‘বুঝিয়ে বাড়ি পাঠানোর’ অতিরিক্ত কর্তব্য কি তাঁরাও গোপনে পালন করছেন?
এ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে না চাইলেও রাজ্য পুলিশের কর্তাদের দাবি, গাফিলতি বুঝেই এক পুলিশ আধিকারিককে ক্লোজ় করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যদিও বাহিনীর সঙ্গে যুক্তদের একাংশের দাবি, পর পর মহিলা থানা তৈরি করা হলেও সেগুলিকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তদন্ত দূর অস্ত্, কোথাও অভিযানে যেতেও মহিলা থানাকে অন্য থানার অনুমতি নিতে হয়! এমনই এক মহিলা থানার আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘জেলায় এমন প্রচুর মহিলা থানা রয়েছে, যেখানে মত্তদের ভয়ে রাতে তালা ঝুলিয়ে দিতে হয়। তদন্ত করার বা ব্যবস্থা নেওয়ার মতো লোক কোথায়? রক্তশূন্য হয়েই চলছে মহিলা থানা।’’
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলকে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। উত্তর দেননি টেক্সট মেসেজ বা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজেরও। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার যদিও দাবি, মহিলাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের ঘটনার তদন্ত করে মহিলা থানাই। তাই রাজ্যে আরও ২০টি মহিলা থানা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন। জানা গিয়েছে, রাজ্যে প্রথম মহিলা থানা তৈরি হয় ২০১২ সালে, আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে। নতুন করে দু’দফায় আরও মহিলা থানা গড়া হলেও বাহিনীতে মহিলা পুলিশকর্মীর সংখ্যা সে-ভাবে বাড়েনি। বর্তমানে রাজ্য পুলিশে মহিলা কর্মীর সংখ্যা ন’হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু মহিলা ইনস্পেক্টর মাত্র ২৩ জন, সাব-ইনস্পেক্টরের সংখ্যা ৩৭০। মহিলা কনস্টেবল সাড়ে আট হাজারের মতো। এ ছাড়া, রাজ্যের হাতে রয়েছে দু’হাজারের বেশি মহিলা হোমগার্ড এবং এনভিএফ কর্মী। প্রতিটি মহিলা থানায় এক জন ইনস্পেক্টর, আট জন সাব-ইনস্পেক্টর (এসআই), আট জন এএসআই এবং ৩০ জন কনস্টেবল থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে এত মহিলা পুলিশকর্মী নেই। এমনিতে প্রতিটি থানায় মহিলা এসআই ও এএসআই দেওয়ার কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি মহিলা থানায় রয়েছেন হাতে গোনা কয়েক জন অফিসার এবং কর্মী। যা নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার মহিলা থানার এক অফিসার বললেন, ‘‘গুরুতর অভিযোগ এলে ঠিক সময়ে স্যরেদের কানে তুলে দিতে পারলেই দায় শেষ। বারাসতের ঘটনায় সম্ভবত সেই ‘দায়’ পালনেই ভুল হয়েছে।’’