আতঙ্ক: ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন সরকার দম্পতি। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
সন্ধ্যা নামতেই একটা আতঙ্ক এসে চেপে বসছে। সব দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখলেও অস্বস্তিটা কাটছে না বৃদ্ধ দম্পতির। দিনের আলোয় যদি অচেনা যুবক ঢুকে ছিনতাই করে যেতে পারে, তবে রাতে তো আরও ভয়।
দিন দশেক আগের ঘটনা। সকাল তখন সাড়ে সাতটা। ৮০ বছরের সমীর সরকার আর তাঁর ৭২ বছরের স্ত্রী সুচেতাদেবীর সল্টলেকের জিসি ব্লকের বাড়িতে ওই সাতসকালে হানা দেয় ছিনতাইবাজ! পিছনের দরজা খোলা পেয়ে সে ভিতরে ঢোকে। সমীরবাবু তখন বসার ঘরে। তাঁর পিছন দিয়ে সন্তর্পণে একটি ঘরে ঢুকে সমীরবাবুর ঘড়ি, টাকা নেয় ওই যুবক। পাশের ঘরে তার উপস্থিতি ঘুণাক্ষরেও টের পারেননি সমীরবাবু।
ওই ঘর থেকে সটান শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে যুবক। সেই ঘরে তখন শুয়ে ছিলেন সুচেতাদেবী। ওই ঘর থেকে প্রথমে আরও একটি ঘড়ি, টাকা এবং স্মার্টফোন নেয় যুবক। তার পরে সুচেতাদেবীর গলা থেকে সোনার হার ছিনিয়ে নিতে যায়। চমকে উঠে বাধা দেন সুচেতাদেবী। চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু তাঁকে ধাক্কা মেরে সোনার হার ছিনিয়ে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতী।
সল্টলেকে এমন অনেক বৃদ্ধ দম্পতি রয়েছেন, যাঁদের বাড়িতে তাঁরা ছাড়া আর কেউ থাকেন না। কয়েকটি বাড়িতে একা বৃদ্ধ বা একা বৃদ্ধাও থাকেন। বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বিদেশে বা দেশের অন্যত্র চাকরি করেন। দোতলা বাড়ি হলে অনেকে একতলা ভাড়া দিয়ে দেন। সেটাও নিরাপত্তার কাজ করে।
কিন্তু, সমীরবাবুর মতো যাঁদের একতলা বাড়ি, সেখানে সেই নিরাপত্তাই এখন বড়সড় প্রশ্নের মুখে। অনেক পরিবারে সারা দিন-রাতের জন্য পরিচারক বা পরিচারিকা থাকেন। সেটাও নিরাপত্তার কাজ করে। কিন্তু, সমীরবাবুর মতো অনেকে ২৪ ঘণ্টার লোক রাখেন না।
আইএ ব্লকে সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা বৃদ্ধ প্রেমানন্দ ও অনিমা দে। দুই মেয়ে বাইরে থাকেন। অনিমাদেবীর কথায়, ‘‘মেয়েরা যখন ছোট ছিল, তখনও ভয় থাকত। এখন অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। একতলা ভাড়া দেওয়াটাও সেই সতর্কতার অন্যতম কারণ।’’
সমীরবাবুরা জানিয়েছেন, তাঁরা প্রায় ৩৫ বছর ধরে সল্টলেকে রয়েছেন। একমাত্র ছেলে দীপ্তভান বিদেশে চলে যাওয়ার পরে তিনি ও সুচেতাদেবী কাটিয়ে দিয়েছেন ১৯ বছর। কখনও ভয় করেনি। জিসি ব্লকে তাঁদের বাড়িতে ঢোকার চারটি দরজা। দু’টি পাকাপাকি বন্ধ থাকে। সমীরবাবু সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে পিছনের দরজা ও গ্রিলের গেট খোলেন। পিছনেই বাগান। সেখানে ময়লা ফেলার পাত্র রাখা থাকে।
ওই বৃদ্ধের কথায়, তাঁদের ২৪ ঘণ্টার পরিচারক নেই। সকাল সাতটা নাগাদ বাঁশি বাজিয়ে ময়লা নিতে আসেন পুরসভার কর্মীরা।
তার আগেই সামনের দরজা খুলে দেন সমীরবাবু। পুরকর্মীরা এলে ময়লার পাত্র নিয়ে গ্যারাজের পাশ দিয়ে সামনে আসেন। তা ছাড়াও সারা দিনে বেশ কয়েক বার পিছনের বাগানে যাতায়াত করেন তিনি। ফলে পিছনের ওই দরজা সারা দিন খোলাই থাকত। দরজা বন্ধ হতো সন্ধ্যার পরে।
কিন্তু গত ১৪ জুলাই ওই ঘটনার পরে বদলে গিয়েছে সমীরবাবুদের এত দিনকার পরিচিত রুটিন।
পিছনের দরজায় এখন ২৪ ঘণ্টা তালা ঝুলছে। সমীরবাবুর কথায়, ‘‘সন্ধ্যার পর থেকে বুকের উপরে পাথর চাপার মতো ভয় এসে চেপে বসছে।’’
রবিবার সকালে বাড়িতে বসে সুচেতাদেবী বলেন, ‘‘সে দিন যখন শুয়েছিলাম, হঠাৎ এক বার মনে হল আমার মুখের উপরে কেউ যেন ঝুঁকে রয়েছে। চোখ খুলেই দেখি এক অপরিচিত যুবক। নীল-সাদা স্ট্রাইপ ফুল শার্ট। হাতা গোটানো। ফুল প্যান্ট। শ্যামলা গায়ের রং।’’
পুলিশ এসে ওই দম্পতিকে প্রায় ৬-৭টি ছবি দেখায়। কিন্তু তার মধ্যে সেই দুষ্কৃতীর ছবি ছিল না। পুলিশ জানিয়েছে, কুলপি-ক্যানিং এলাকার কিছু যুবক রাতের ট্রেন ধরে শহরে এসে কাকভোরে চুরি করে পালিয়ে যায়। সেই চুরি হয় জানলা দিয়ে শিক গলিয়ে। কিন্তু বাড়ির সদস্যেরা জেগে থাকার সময়ে সকালে বাড়িতে ঢুকে গলা থেকে হার ছিনতাই — এমনটা নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন তদন্তকারী অফিসারেরা।
ওই ‘দুঃসাহসী’কে খুঁজে পাওয়ার জন্য তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া মোবাইলই এখন পুলিশের কাছে একমাত্র ভরসা।