যাত্রী-সুরক্ষার প্রশ্ন তুলে সরকার যাবতীয় শর্ত আরোপ করছে ওলা-উবেরের মতো সংস্থাগুলির উপরে। এই সব সংস্থা শহরবাসীকে দিচ্ছে অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি পরিষেবা। কিন্তু দিন কয়েক আগেই পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করেছেন, সাধারণ ট্যাক্সিতেও অ্যাপ-নির্ভর পরিষেবা চালু হবে। সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে, ট্যাক্সির ক্ষেত্রে তা হলে এমন শর্ত আরোপ করা হচ্ছে না কেন?
প্রশ্নটা আরও উস্কে দিয়েছে দু’দিন আগে রাতের বিধাননগরে উবের-এ এক মহিলার হেনস্থা হওয়ার ঘটনা। ওই ঘটনার পরে সরকার কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওলা, উবেরের মতো সংস্থার উপরে। অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি পরিষেবা সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সে কারণে, অ্যাপ পরিষেবায় ঢুকছে ট্যাক্সিও। কিন্তু তাদের জন্য বাড়তি সুরক্ষার ভাবনা কিছু নেই।
তবে কি ট্যাক্সিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না?
সরকারের যুক্তি, ওলা-উবেরের ক্ষেত্রে যাত্রিভাড়া নিয়ন্ত্রণ করে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। তার উপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু ট্যাক্সির ভাড়া ওলা, উবেরের থেকে অনেক কম এবং ভাড়ার নিয়ন্ত্রক সরকার। তাই সেখানে যাত্রী-সুরক্ষার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে গেলে আগে ভাড়া বাড়াতে হবে।
রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ সরকারের এই অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘লোকাল এবং এক্সপ্রেস ট্রেনের ভাড়াতেও তো ফারাক আছে। যাত্রী সুরক্ষার প্রশ্ন দু’টি ট্রেনের ক্ষেত্রে কি দু’রকম হয়? তা হলে ভাড়ার ধুয়ো দিয়ে ট্যাক্সির ক্ষেত্রে যাত্রী-সুরক্ষার বিষয়টির উপরে গুরুত্ব বাড়ানো হবে না কেন?’’
ওলা, উবেরের ক্ষেত্রে কী কী শর্ত আরোপ করা হয়েছে? পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, শর্তগুলি হল— ১) প্রত্যেক সংস্থাকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুম তৈরি করতে হবে। ২) প্রতি দু’বছর অন্তর লাইসেন্স নবীকরণ করাতে হবে। ৩) পরিবহণ পরিষেবার শর্ত ওই সব সংস্থা পূরণ করতে না পারলে সরকার প্রয়োজনে তাদের লাইসেন্স বাতিল করবে। ৪) প্রতিটি সংস্থাকে পারফরম্যান্স অডিট করাতে হবে। ৫) গাড়িতে সংস্থার পোশাক ও লোগো থাকতে হবে। ৬) গাড়িতে বাধ্যতামূলক ভাবে রাখতে হবে জিপিএস পরিষেবা এবং ‘ফিজিক্যাল প্যানিক বাটন’। ৭) থাকতে হবে সিসি ক্যামেরার নজরদারি। ৮) চালকের বিস্তারিত বিবরণ সরকার অনুমোদিত নিরাপত্তা সংস্থাকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
তবে গাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো খরচসাপেক্ষ বলে আপত্তি তুলেছে লাক্সারি ট্যাক্সি সংস্থাগুলি। তাদের আপত্তিতে পিছু হটে ওই শর্ত শিথিল করে সরকার বলেছে, সিসি ক্যামেরা লাগালেও তার ছবি থাকবে গাড়িতেই। ৭২ ঘণ্টা তা দেখা যাবে। ইতিমধ্যেই এই শর্ত শিথিল করতে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে পরিবহণ দফতর। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকেই ওই প্রস্তাব উঠতে পারে।
তবে সিসি ক্যামেরার বিষয়ে সরকার নমনীয় হলেও শহরে ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুম খোলা, গাড়িতে প্যানিক বাটন লাগানো, চালকদের ছবি-সহ সব কিছু সরকারকে জানানোর মতো শর্ত পালনে কঠোরতা বজায় থাকছে। চলতি বছরের শুরুতে সরকার ওলা, উবেরের মতো সংস্থাগুলিকে তিন মাসের অস্থায়ী লাইসেন্স দিয়েছিল। সংস্থাগুলি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সব শর্ত মানা হবে, কিন্তু বাস্তবায়িত করতে সময় লাগবে। ১৫ মে ছিল সেই সব শর্ত পূরণের শেষ দিন। সেই তারিখ বাড়িয়ে ১৫ অগস্ট করা হয়েছে। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘১৫ অগস্টের পরে এক দিনও সরকার অস্থায়ী লাইসেন্সের সময়সীমা বাড়াবে না। সংস্থাগুলিকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’
পাশাপাশি, বিধাননগরের ঘটনার প্রেক্ষিতে উবেরকে শো-কজ করছে সরকার। উবের এবং ওলার মতো সংস্থাগুলিকে তাদের গাড়ি ও সংশ্লিষ্ট চালকদের বিস্তারিত জমাও দিতে বলা হয়েছে। ১৫ অগস্টের মধ্যে ওই তথ্য জমা পড়ার পরে পরিবহণ দফতর নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখবে, তা সঠিক কি না।
প্রশ্ন উঠেছে, ওলা, উবেরের মতো সংস্থার জন্য নানা শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ ট্যাক্সি বা বেসরকারি বাস-মিনিবাসের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত এমন শর্ত কোথায়? প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘ওলা, উবের যে ভাবে সাধারণ ট্যাক্সির বাজার খেয়ে নিয়েছে, তাতে পরিবহণ দফতরের অনেক অফিসারই সন্তুষ্ট নন। তাঁরাই নানা ভাবে ওলা-উবের নিয়ে আপত্তি তুলছেন।’’
এই প্রেক্ষিতে নবান্নের অন্দরে একাংশের প্রশ্ন, ওলা-উবেরের দেখাদেখি এ বার ট্যাক্সিও অ্যাপ-নির্ভর পরিষেবা দেবে। সে ক্ষেত্রে যাত্রী নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি কেন অগ্রাধিকার পাবে না?
পরিবহণ কর্তাদের পাল্টা যুক্তি, ‘‘এক জন ট্যাক্সিমালিক সরাসরি সরকারের থেকে পারমিট নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। ভাড়া ঠিক করে দিচ্ছে সরকার। যাত্রী-সুরক্ষার বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দিতে গেলে আগে ভাড়া বাড়াতে হবে। তা হলে আবার সাধারণের হাতের বাইরে চলে যাবে ট্যাক্সি। এই সব ভেবেই ওই শর্তগুলি আরোপ করা যাবে না।’’ আর এখন কেন্দ্রের নয়া আইন অনুযায়ী রাত জাগবে শহর। রাতে পরিষেবা চালু হলে ‘প্যানিক বাটন’ বা ‘সিসি ক্যামেরা’ ছাড়া কি ট্যাক্সি বা বেসরকারি বাসে নিরাপত্তা আদৌ সুনিশ্চিত করা যাবে?
পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘ট্যাক্সি বা বাসের ক্ষেত্রে এমন নিয়ম তৈরি হবে কি না, তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে রাতে প্রচুর পরিমাণে বাস-ট্যাক্সি চালু হলে তখন যাত্রী-সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে ভাবতেই হবে।’’
আপাতত তাই ‘প্রয়োজন বুঝে ব্যবস্থা’ নেওয়ার নীতিতেই হাঁটতে চাইছে পরিবহণ দফতর। ফলে ছাড় পাবে ট্যাক্সি, পাবে না ওলা-উবের।