গোঁজরাই বেশি নিচ্ছে, আপনার ক’পিস চাই

ছোট একটি ঘরে এক মনে কাজ করছেন কয়েক জন যুবক। প্রত্যেকের পাশে রাখা একটি করে কেরোসিন তেলের জার। স্টিলের থালায় কেরোসিনে ভেজানো ‘লাল-সাদা’ মশলা, সুতলি দড়ি, জালকাঠি, পেরেকের কুচি। সামনে খবরের কাগজ পাতা রয়েছে। ছোট ছোট চটের টুকরোর মধ্যে কেরোসিন ভেজানো লাল-সাদা মশলা পুঁটলি করে কাগজে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপর ওই পুঁটলি আরেকটি কাগজের উপর রেখে জালকাঠি ও পেরেকের টুকরো পুরে তা সুতলি-দড়ি দিয়ে বাঁধছেন কর্মীরা।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪১
Share:

চলছে পেটো বাঁধার কাজ। —নিজস্ব চিত্র।

ছোট একটি ঘরে এক মনে কাজ করছেন কয়েক জন যুবক। প্রত্যেকের পাশে রাখা একটি করে কেরোসিন তেলের জার। স্টিলের থালায় কেরোসিনে ভেজানো ‘লাল-সাদা’ মশলা, সুতলি দড়ি, জালকাঠি, পেরেকের কুচি। সামনে খবরের কাগজ পাতা রয়েছে। ছোট ছোট চটের টুকরোর মধ্যে কেরোসিন ভেজানো লাল-সাদা মশলা পুঁটলি করে কাগজে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপর ওই পুঁটলি আরেকটি কাগজের উপর রেখে জালকাঠি ও পেরেকের টুকরো পুরে তা সুতলি-দড়ি দিয়ে বাঁধছেন কর্মীরা।

Advertisement

কী তৈরি হচ্ছে এই কারখানায়?

এঁদের ভাষায়— ‘পেটো’। পোশাকি নাম হাতবোমা। পুরভোটের আগে যার এতই চাহিদা যে, দিনরাত কাজ করেও সামাল দিতে পারছেন না বন্দর এলাকার এই কারখানার কর্মীরা।

Advertisement

খবর ছিল, বন্দরের মেটিয়াবুরুজ এলাকার প্রায় শেষ প্রান্তের এক গলিতে কয়েকটি ছোট ছোট বাড়িতেই ভোটের জন্য তৈরি হচ্ছে নানা দামের হাতবোমা। এলাকার এক দাদার সাহায্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে ক্রেতা সেজে হাজির হয়েছিলাম তেমন এক কারখানায়। দরজা খুলতেই কারখানা মালিকের প্রশ্ন, ‘‘আপনি কি গোঁজ প্রার্থীর হয়ে এসেছেন?’’ কেন এই প্রশ্ন? এলাকার দাদা বুঝিয়ে দিলেন, ‘‘এ বার গোঁজ প্রার্থীরাই বেশি মাল কিনছেন যে! তাই আপনাকেও তাঁদের লোক ভেবেছে।’’

কী দামে পাওয়া যাবে পেটো? বছর পঁচিশের কারখানার মালিক বললেন, ‘‘একদম কমজোরি পেটোর এক-একটা সাড়ে চারশো টাকার কমে দেওয়া যাচ্ছে না।’’ পেটোর এই মূল্যবৃদ্ধির কারণও সরল করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি। ‘‘এ বার দাম অনেকটাই বেশি। পেটোর মশলার দাম অনেক বেড়েছে। বছরখানেক আগে মশলার দাম ছিল প্রতি কিলো দেড় হাজার টাকা। এ বছর তা বেড়ে প্রায় আড়াই হাজার হয়েছে।’’ মশলার দামের পাশাপাশি কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকিও তো রয়েছে। মালিক বলছিলেন, ‘‘প্রতি পেটোর মজুরিই ৫০ টাকা করে দিতে হয়। তবে দাদার সঙ্গে এসেছেন। বেশি দাম নেব কী করে? দাদা তো সারা বছরই নেন। আসুন ভেতরে।’’

ঢুকলাম ভেতরে। বাঁধা খরিদ্দার ও তাঁর সঙ্গীর জন্য চা আনালেন কারখানা মালিক। চা খেতে খেতেই শুরু হল দরদাম। ঠিক হল, ভাল পেটোর জন্য সাড়ে চারশো টাকা করে দিতে হবে। কেমন হবে সেই বোমা? মালিকের কথায়, ‘‘এই পেটোয় একশো গ্রাম লাল-সাদা মশলা থাকবে। আওয়াজ আর ধোঁয়া বেশি চাইলে একশো গ্রাম মশলা লাগবেই। এতে থাকবে পেরেক, জালকাঠির মতো মারাত্মক জিনিসও।’’ মানে স্‌প্লিন্টার আর কি!

কিন্তু বোমা বয়ে নিয়ে যাব কী করে?

উপায় বাতলালেন মালিকই। হাত নেড়ে বললেন, ‘‘কেরোসিনে ভাল করে ভিজিয়ে দেব। মশলা ভিজে থাকবে। কোনও অসুবিধে হবে না। কেরোসিন ভিজে থাকলে, যতক্ষণ না বড় ধাক্কা খাবে, ততক্ষণ ফাটবে না।’’ কেরোসিন শুকিয়ে যাওয়ার পরে বোমা ছুড়লে লাল-সাদা মশলা ফস্ করে ধরে গিয়ে বিকট শব্দে ফাটবে। ধোঁয়ায় এলাকা ঢেকে দেবে। ‘‘মশলা যত শুকোবে ততই মজা!’’

কেমন চলছে কারবার?

দাঁত বার করে হাসলেন মালিক। ‘‘এ বারের ভোটে বোমার বাজার মোটামুটি ভালই। এত চাহিদা যে জোগান দিতেই হিমসিম খাচ্ছি।’’ কিন্তু আমাকে প্রথম দেখেই গোঁজ মনে করলেন কেন? এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিলেন যুবকটি। তার পর বললেন, ‘‘মাস দুয়েক ধরে পেটো বিক্রি করতে করতে একটা জিনিস বুঝে গিয়েছি, দাদা। এ বার কলকাতার ভোট হচ্ছে তৃণমূল বনাম তৃণমূল। গোঁজ বনাম অফিশিয়াল। এখনও পর্যন্ত হাজার দশেক পেটো বিক্রি হয়েছে। তার মধ্যে গোঁজরাই কিনেছেন হাজার চারেক।’’ কারখানা মালিক নিশ্চিত, কলকাতার উত্তরে ও পূর্বে অধিকাংশ জায়গায় এ বারের পুরভোটে তাঁর সরবরাহ করা পেটোই ফাটবে। মনে হল, যেন প্রথম সারির পুজো-সাজানো আলোকশিল্পী বা মণ্ডপশিল্পীর কথা শুনছি।

এ বার আসল প্রশ্ন। ছদ্মবেশী সাংবাদিকের দিকে ঝুঁকে পড়ে মালিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনার কত লাগবে? নেবেন কবে?’’ আমায় ঢোঁক গিলতে দেখে ম্যানেজ দিলেন সেই দাদা। বললেন, ‘‘পরে আমি ফোন করে তোকে বলে দেব, মোট ক’পিস লাগবে। তখন ওঁকে নিয়ে ফের আসব।’’

উত্তর এল, ‘‘ও কে, ও কে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement