(বাঁ দিকে) আটলান্টায় প্রতিবাদ-সমাবেশ। ওয়েস্ট লন্ডনের হন্সলোয় (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের মৃত্যুর প্রতিবাদে গত কাল রাত-পথ দখল করেছিলেন বঙ্গবাসী। যার অনুরণন ছড়িয়ে গিয়েছিল বিশ্বের নানা প্রান্তে। আমেরিকার বস্টন বা আটলান্টা, ইউরোপের ক্রাকোভ বা এডিনবরা, চিকিৎসক-হত্যার নিন্দায় সরব হয়েছিলেন কলকাতা থেকে অনেক দূরের এই সব শহরে বসবাসকারী ভারতীয়েরা। যাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ বাঙালি এবং চিকিৎসক।
যেমন পশ্চিম লন্ডন শহরতলির হন্সলো। হিথরো বিমানবন্দরের খুব কাছের এই এলাকায় প্রচুর ভারতীয়ের বাস। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে গত কাল ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ১১টায় সেখানে জমায়েত হয়েছিল বলে জানালেন প্রত্যুষা দত্তরায় ও সৈকত বসু। প্রত্যুষার বন্ধু দিশারী দাস কলকাতার এসএসকেএম থেকে ডাক্তারি পাশ করে এখন আছেন ম্যাঞ্চেস্টারে। তাঁর কাছ থেকেই আরজি করের ঘটনা সম্পর্কে শুনেছিলেন প্রত্যুষারা। পরে বিলেতের একটি পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদনও পড়েছেন। প্রত্যুষার কথায়, ‘‘দিশারী যে-হেতু কলকাতায় ডাক্তারি পড়েছে, ও এই ঘটনায় আরও বেশি মর্মাহত, ট্রমাটাইজ়ড। আমাদের এখানে হয়তো মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে এত চিন্তা নেই। কিন্তু আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের খুবই নাড়া দিয়েছে।’’ কালকের জমায়েতে শ’দেড়েক মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই বাঙালি। মেয়েদের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের দাবি তোলেন তাঁরা। লন্ডনের অন্যান্য এলাকা ও স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরাতেও জমায়েত করেছিলেন বাঙালিরা। প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় পোল্যান্ডের ক্রাকোভ শহরেও।
আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়ার ডাবলিনে গত কাল এক প্রতিবাদ-জমায়েতে অংশ নিয়েছিলেন সেখানে বসবাসকারী বহু ভারতীয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সে-দেশেই জন্মেছেন, এমন নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও। সমাবেশ থেকে জানানো হয়, মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে।
বস্টনের শহরতলি অ্যাশল্যান্ডে আশপাশের বহু শহরের বাঙালিরা তাৎক্ষণিক উদ্যোগে জমায়েতের আয়োজন করেন। গান, কবিতা ও নীরবতায় তাঁরা স্মরণ করেন মৃতা চিকিৎসককে। বার্তা দেন, ওই চিকিৎসক ও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবাদী মহিলাদের পাশে আছেন তাঁরা।
‘তোমার পাশে আছি’, কলকাতাকে এই বার্তা পাঠিয়েছেন আমেরিকার আটলান্টার বাসিন্দারাও। গত কাল তাঁদের এক জমায়েতে হাজির হয়েছিলেন শ’দুয়েক মানুষ। আটলান্টাবাসী শুভশ্রী নন্দীর কথায়, ‘‘গত কাল সাধারণ কাজের দিন ছিল। কিন্তু সেই দিনটিকেই ব্যতিক্রমী করতে আমরা সবাই পৌঁছে গিয়েছিলাম শহর থেকে ঘণ্টা খানেক দূরে, ‘গ্লোবাল মল’ প্রাঙ্গণে। সেখানে মৃতাকে স্মরণ করে মোমবাতি জ্বালানো হয়, বক্তব্য রাখেন অনেকে। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও সব শেষে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।’’ এই জমায়েতের অন্যতম আয়োজক ঋচা সরকার বললেন, ‘‘আমরা এই বার্তা দেশে পৌঁছে দিতে চাই যে, আমরাও শহরের দুর্দিনে, রাজ্যের দুর্দিনে, বাংলা ও দেশের দুর্দিনে দেশবাসীর মতো করেই ওঁদের পাশে রয়েছি।’’ আর এক আটলান্টাবাসী বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যের গলায় হতাশা, ‘‘জীবনে এই প্রথমবার বাঙালি হিসেবে গর্ব না হয়ে লজ্জাবোধ হচ্ছে।” জমায়েতের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ব্যাসদেব সাহার মতে, “আমাদের এখন আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। দশ বছর আগের কামদুনি-কাণ্ডের অধিকাংশ আসামী বিচারে খালাস পেয়ে গিয়েছে। বছর খানেক আগে নদিয়ার হাঁসখালিতে একটি মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। বিচার হয়নি। আজকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও বিচারব্যাবস্থা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।”
কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে রাত দখলের বার্তা দিয়েই কালকের জমায়েতগুলি হয়েছিল। আটলান্টার উজ্জ্বল চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিলেন, ১৯৭৫ সালে ফিলাডেলফিয়ার একটি ঘটনা ও তা ঘিরে প্রতিবাদের কথা। ফিলাডেলফিয়ার মাইক্রোবায়োলজিস্ট সুজ়ান আলেকজ়ান্ডার স্পিথের উপর নির্মম অত্যাচার করে তাঁকে হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে একটি বড় মাপের আন্দোলন গড়ে ওঠে, আন্দোলনকারীরা যার নাম দেন—‘রিক্লেম দ্য নাইট।’ পরে সেই আন্দোলন রোমে ও লন্ডনেও ছড়িয়ে পড়ে। উজ্জ্বলের কথায়, ‘‘কখনও ভাবিনি কলকাতার মেয়েদেরও রাত দখল করতে পথে নামতে হবে।’’