উৎসবের প্রাঙ্গণ থেকে শরীর সম্পর্কে অজানা তথ্য ও সচেতনতার বার্তাই দিতে চায় মৈত্রী সংসদ।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিভিন্ন গ্রামের পথ ধরে বাঁক কাঁধে নিয়ে ছুটে যান তাঁরা। সেই পথেই গ্রামবাসীদের মধ্যে লিফলেট বিলি করেন। যাতে লেখা থাকে মরণোত্তর দেহ এবং অঙ্গদানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে যখন মহারাষ্ট্রে এমন পদক্ষেপ হয়েছে, তখন প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের এই রাজ্যে এখনও মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গদান নিয়ে অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা।
তাই ব্রেন ডেথের পরে অঙ্গদান করায় উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার কৃষক সূর্যকান্ত মণ্ডলের পরিবারকে প্রতিবেশীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। হেনস্থার শিকার হতে হয়। গত বছরের সেই ঘটনা এবং মহারাষ্ট্রের এ হেন অভিনব প্রচারের কথা বলছিলেন এ রাজ্যের ‘রিজিয়োনাল অর্গ্যান অ্যান্ড টিসু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজ়েশন’ (রোটো)-এর যুগ্ম অধিকর্তা, চিকিৎসক অর্পিতা রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘উৎসবের প্রাঙ্গণ থেকে যদি সামাজিক সচেতনতার বার্তা দেওয়া যায়, তা হলে তার প্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়। খুব সহজেই এ ভাবে বড় সংখ্যক মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়।’’
রাজ্যে এখন মরণোত্তর অঙ্গদান এবং দেহদান হচ্ছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে করেন এই কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত মানুষেরা। তাঁদের আক্ষেপ, অঙ্গদান বা দেহদানে সচেতনতার নিরিখে এখনও অনেকটা পিছিয়ে এই রাজ্য। তাই এ বার নিজেদের উৎসবের প্রাঙ্গণকে মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহদানের প্রচারের মঞ্চ হিসাবে বেছে নিয়েছে বাঘা যতীন মৈত্রী সংসদ পুজো কমিটি। হৃৎপিণ্ড, কিডনি, যকৃৎ ও চোখের মডেলেই সাজবে সেই মণ্ডপ। যেখানে দেখানো হবে, ওই সমস্ত অঙ্গ এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য গ্রিন করিডরের ভূমিকাও। পুজোর সাংস্কৃতিক সম্পাদক তথা শিল্পী সোমনীল সাহা বললেন, ‘‘একটা মৃত্যুতেই সব শেষ নয়। বরং অজানতেই তা আরও চার-পাঁচ জনকে নতুন প্রাণ দিতে পারে। সেটা সকলের কাছে তুলে ধরাটা আজকের সমাজে অত্যন্ত জরুরি।’’
কোথা থেকে তাঁদের এমন ধারণার জন্ম, তা-ও জানালেন একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্ণধার সোমনীল। আড়াই বছর আগে এলাকারই বাসিন্দা, বছর ২৯-এর যুবক রাহুল দে-র দু’টি কিডনিই খারাপ বলে জানা যায়। কেব্ল অপারেটর সংস্থার সামান্য বেতনের কর্মী রাহুলকে এখন নিয়মিত ডায়ালিসিস করাতে হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বছরখানেকের মধ্যে ওই যুবকের কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। কিন্তু বললেই তো কিডনি পাওয়া সম্ভব নয়। রাজ্যে অপেক্ষমাণ গ্রহীতার তালিকাও দীর্ঘ। টিভি-খবরের কাগজের মাধ্যমে নয়, চোখের সামনে এমন ঘটনাই ভাবিয়েছিল ওই পুজোর সম্পাদক দীপঙ্কর মজুমদার ও অন্যদের। তার পরেই শুরু ভাবনার রূপরেখা তৈরি।
সেই রূপরেখায় আরও রসদ জোগাতে ওই পুজো কমিটির কাছে পৌঁছে যান গণদর্পণের শ্যামল চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যে ও দেশে প্রতিদিন দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে ভেন্টিলেশনে থাকা অনেকের ব্রেন ডেথ হচ্ছে। এই ধরনের মৃত্যুতে যদি মৃতের পরিবার অঙ্গদান করে, তা হলে অসংখ্য রাহুল নতুন প্রাণ পেতে পারেন। সমাজে এই বিষয়টিকে আরও জোরদার করতে হলে সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।’’ শ্যামল আরও বলেন, ‘‘চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতিতে মরণোত্তর দেহদানের গুরুত্ব কতটা, তা এখনও অনেকেরই অজানা। অথচ, ওই গবেষণা চলে আমাদেরই স্বার্থে।’’ উৎসবের প্রাঙ্গণ থেকে সেই অজানা তথ্য ও সচেতনতার বার্তাই দিতে চায় মৈত্রী সংসদ। যেখানে দুর্গার কোলে মৃত অসুরের নাভি থেকে জন্ম নিচ্ছে চারাগাছ। যা এক মৃতের শরীর থেকে অনেকগুলি জীবনকে নতুন শক্তি দানের প্রতীক।