টানটান থ্রিলার গায়ে কাঁটা ধরায়। বাস্তবের থ্রিলার কাঁটা দেয় বোধবুদ্ধির গায়েও!
যেমন হল বুধবার সন্ধ্যায় কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে। সেখানে এক বাণিজ্যিক সংস্থার ডিরেক্টরের কাছ থেকে নগদ ২০ লক্ষ টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন এক সিনিয়র আইএএস অফিসার। তিনি কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ। গ্রেফতার করা হয়েছে ভারত ক্যালকাটা কন্টেনার্স টার্মিনাল লিমিটেড নামে একটি বাণিজ্যিক সংস্থার ডিরেক্টর ডি ডি জগতাপ দত্তাজিকে। কাহালোঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সরকারি নিরাপত্তারক্ষীও। তবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি। আদালত আজ কাহালোঁ এবং দত্তাজিকে পুলিশ হেপাজতে পাঠিয়েছে। ১৭ মার্চ পর্যন্ত তাঁরা পুলিশ হেফাজতে থাকবেন।
১৯৮৪ ব্যাচের আইএএস কাহালোঁ ২০১২ থেকে বন্দরের চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্য, পরিবেশ প্রভৃতি দফতরের সচিব ছিলেন।
পুলিশ জানায়, ওই হোটেলে কাহালোঁ ও জগতাপকে বেআইনি ভাবে ২০ লক্ষ টাকা লেনদেনের অভিযোগে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৭ (ঘুষ দেওয়া-নেওয়া), ১২ (দুর্নীতি রোধ) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি (অপরাধমূলক যড়যন্ত্র) ধারায় মামলা রুজু হয়েছে।
কাহালোঁর গ্রেফতার পর্ব ছিল নাটকে মোড়া। হোটেলে ওত পেতে ছিলেন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স এবং নিউ মার্কেট থানার অফিসারেরা। বিকেলে কাহালোঁ ওই হোটেলের একতলার রেস্তোরাঁয় পৌঁছন। ওই হোটেলেরই একটি ঘরে ছিলেন জগতাপ। তিনি ২০ লক্ষ টাকা ভর্তি একটি ব্যাগ নিয়ে রেস্তোরাঁয় পৌঁছন। দু’জনে কিছু ক্ষণ কথা বলেন রেস্তোরাঁয়। তার পরে পোর্টিকোয় আসেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল কাহালোঁর এসইউভি। টাকার ব্যাগটি তাঁর রক্ষীর হাতে দেন জগতাপ। রক্ষী ব্যাগটি গাড়িতে তুলতেই তিন জনকে ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকের পুলিশ।
পুলিশি সূত্র জানাচ্ছে, হোটেলে টাকা লেনদেন হবে, এ কথা কয়েক দিন আগেই জেনেছিলেন গোয়েন্দারা। সেই অনুযায়ী ফাঁদ পাতা হয়। তিন দিন ধরে অনুসরণ করা হয় কাহালোঁকে। এ দিন ধরা পড়ে গিয়েও কাহালোঁ ওই টাকা তাঁর নিজের বলে দাবি করেন। ওই টাকা যে তাঁরই, তা প্রমাণ করার জন্য প্রায় দু’ঘণ্টা সময় দেওয়া সত্ত্বেও তিনি হিসেব দাখিল করতে পারেননি। এ দিন কাহালোঁর রক্ষীর বয়ানও নথিভুক্ত করা হয়েছে।
কাহালোঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এই প্রথম নয়। বন্দরের খবর, সেখানে পণ্য খালাসের জন্য বাঁকা পথে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার বরাত পাওয়ার ঘটনায় বারবার জড়িয়েছে কাহালোঁর নাম। তবে কখনওই সরাসরি কোনও প্রমাণ মেলেনি। বন্দরের অফিসারদের একাংশও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন ঘনিষ্ঠ মহলে। তাঁদের অভিযোগ, বিভিন্ন বৈঠকে কেপিটি-র চেয়ারম্যান নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে একার মতো সিদ্ধান্ত নেন এবং তাতে আখেরে দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
এ দিন ঘুষ নিতে গিয়ে কাহালোঁকে যে-ভাবে শ্রীঘরে পোরা হয়েছে, সেই পদ্ধতি সাধারণত অনুসরণ করে সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) কিংবা ভিজিল্যান্স দফতর। পুলিশি সূত্রের খবর, সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। পুলিশ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বেআইনি টাকা লেনদেনের দিকে বাড়তি নজর রাখছে। সেই নজরদারির সূত্রেই গোয়েন্দাদের কাছে খবর আসে, শহরের প্রাণকেন্দ্রে ওই পাঁচতারা হোটেলে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হবে। এবং এক সিনিয়র আইএএস অফিসার তাতে জড়িত। সেই আমলা যে কাহালোঁ, সেটা প্রকাশ পায় ধাপে ধাপে।
কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার কর্তাদের দুর্নীতি রোধে সাধারণত ধরপাকড় করে সিবিআই। এ ক্ষেত্রে লালবাজার গ্রেফতার করল কেন?
পুলিশের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, যে-কোনও নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার কর্তাদের দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে সিবিআই বা কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স থাকলেও নির্বাচনী বিধিতে রাজ্য পুলিশও গ্রেফতার করতে পারে। সেই নিয়মেই এ দিন কাহালোঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।