রোশনাই: বৃহস্পতিবার সল্টলেকে আলোর উৎসব। নিজস্ব চিত্র
তখনও বৃহস্পতিবারের সূর্য ডোবেনি। কিন্তু মহানগরের আনাচকানাচে হাজিরা জানাতে শুরু করেছিল শব্দদৈত্য! সন্ধ্যা পেরোতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযোগও আসতে শুরু করে পুলিশের কাছে। শুরু হয় পুলিশ এবং বাজিকরদের লুকোচুরি খেলা। লালবাজারের খবর, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই তাদের কাছে ২৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
পরিবেশকর্মীদের যৌথ সংগঠন সবুজ মঞ্চের কন্ট্রোল রুমেও সন্ধ্যা থেকেই অভিযোগ জমা পড়ছিল। সেখান থেকেও পুলিশের কাছে ফোন গিয়েছে। ৯০ ডেসিবেলের বেশি মাত্রার শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়েছে বহু বছর আগে। ফি বছর শব্দবাজির বিরুদ্ধে প্রচারও করে পুলিশ-প্রশাসন। তবুও নজর এড়িয়ে শব্দবাজির কারবার চলেই। কালীপুজোর রাতে দাপট দেখায় শব্দদানব। তবে অনেকে এ-ও বলছেন, ইদানীং সামান্য হলেও শব্দবাজির উপদ্রব কমেছে। কিন্তু যন্ত্রণার তুলনায় তা কিছুই নয়।
পুলিশ সূত্রের খবর, মানিকতলা, ফুলবাগান, জোড়াবাগান, বেলগাছিয়া, নেতাজিনগর, ঠাকুরপুকুর, বেহালা, তিলজলা, সিঁথি, হরিদেবপুর, সরশুনা এলাকায় বেশি শব্দবাজি ফেটেছে। সালকিয়া-সহ হাওড়ার কিছু কিছু এলাকাতেও শব্দবাজি ফাটার অভিযোগ মিলেছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, মধ্য কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকেও শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগ মিলেছে। লেক টাউন, কালিন্দী, দমদমের মতো এলাকাতেও থেকে থেকেই বাজির শব্দ শোনা গিয়েছে। নেতাজিনগর, পাটুলির অনেক বাসিন্দারই অভিযোগ, রাত যত গড়িয়েছে, ততই বাজির শব্দ বেড়েছে। ওই সব এলাকায় পুলিশের নজরদারিও কম ছিল বলে অভিযোগ। কালীপুজোর বিকেলেও বড়বাজার এলাকা থেকে ২৫ কিলোগ্রাম নিষিদ্ধ শব্দবাজি আটক করে পুলিশ।
শব্দবাজি যে খেল দেখাবে, তা বুধবার রাত থেকেই মালুম হচ্ছিল। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পেরোলেও বাজির শব্দ থামছিল না। নিরুপায় হয়ে
অনেকে থানায় জানিয়েছেন, কেউ বা সংবাদপত্রের অফিসে ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন। এমন অভিযোগের সংখ্যা সল্টলেক বা দমদমের মতো এলাকায় ছিল বেশি। তিলজলা, বালিগঞ্জের কিছু এলাকাতেও শব্দবাজি ফাটার অভিযোগ উঠেছে।
সল্টলেকের এফ ডি ব্লকের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক জানান, গভীর রাত পর্যন্ত বাজি ফেটেছে। দরজা, জানলা বন্ধ করেও আওয়াজ থেকে মুক্তি মেলেনি। যদিও স্থানীয় গোলমালের ভয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার সাহস পাননি ওই ব্যক্তি।
পুলিশ সূত্রের খবর, নিউ টাউনে এক শপিং মলের কাছে চারটি আবাসনে দেদার শব্দবাজি ফাটছিল। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে পৌঁছয়। আবাসিক কমিটির কাছ থেকে শব্দবাজি আর না ফাটানোর মুচলেকা লেখানো হয়। সাধারণত যে এলাকায় বেশি শব্দবাজি ফাটে, সেখানে অতিরিক্ত নজরদারি রাখা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে বারবার দাবি করা হয়েছে, শব্দবাজি পাকড়াও করতে অভিযান চলেছে। শুধু কলকাতা পুলিশই প্রায় ৪০০০ কেজি বাজি আটক করেছে। তা হলে এত শব্দবাজি ফাটল কী ভাবে? পুলিশের একাংশের ব্যাখ্যা, যে পরিমাণে শব্দবাজি আটক হয়েছে, তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। নজর এড়িয়ে আগে থেকেই বহু শব্দবাজি
লোকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। পুলিশের কেউ কেউ অবশ্য বলছে, ইদানীং লোকে অভিযোগের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সব জায়গার পরিস্থিতি ঠিক মতো জানা যাচ্ছে না।
পুলিশ জানিয়েছে, কালীপুজোর সন্ধ্যায় ৩৬টি শব্দবাজির অভিযোগ জমা পড়েছে। লাউডস্পিকারের অভিযোগ দায়ের হয়েছে চারটি। ৩৩ জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। ১৫৪ কেজি বাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে বলে সূত্রের খবর।
যদিও আমনাগরিকদের অনেকেই বলছেন, পুলিশ অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখার কথা বললেও নানা ভাবে অভিযোগকারীর নাম এলাকায় ফাঁস হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী কালে গোলমালে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বহু ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা লোকজন শব্দবাজি ফাটালে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নিতে চায় না বলেও অভিযোগ আছে নানা জায়গায়।
তা হলে কি শব্দবাজির এই পরম্পরাই চলতে থাকবে?
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের খবর, শব্দবাজি আগের থেকে কমেছে। তবে সচেতনতা আরও না বাড়লে এই বিপদ ঠেকানো যাবে না। পুলিশের দাবি, এ বার পদস্থ কর্তারা রাস্তায় নেমে মানুষকে বুঝিয়েছেন। তার একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘এক বছরে তো এত দিনের অভ্যাস বদলাবে না। লাগাতার প্রচার এবং অভিযানে ধীরে ধীরে শব্দবাজি নিশ্চিহ্ন হবে।’’