আহত শিশুকে প্রত্যাখ্যান

নার্সিংহোমের সাফাই, মানেনি পুলিশ

নগদ টাকা না পেয়ে বুধবার ডানলপের দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়ায় অভিযুক্ত পার্ক ক্লিনিক তাদের সাফাই দিল বৃহস্পতিবার। তবে তাতে ওই নার্সিংহোমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আরও বাড়ল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

নগদ টাকা না পেয়ে বুধবার ডানলপের দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়ায় অভিযুক্ত পার্ক ক্লিনিক তাদের সাফাই দিল বৃহস্পতিবার। তবে তাতে ওই নার্সিংহোমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আরও বাড়ল।

Advertisement

এ দিন ওই নার্সিংহোমের তরফে সুদীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিশুটির রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। অবিলম্বে রক্ত দেওয়া জরুরি ছিল। আমাদের এখানে ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই। ভর্তি করে রক্তের ব্যবস্থা করতে করতে আরও ঘণ্টা দুয়েক লেগে যেত। ততক্ষণে শিশুটির অবস্থা আরও খারাপ হত। হাসপাতালের তরফে বার বার সেটাই বলা হয়েছে। পুলিশ সেটা বুঝতে পারেনি। এই ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বেশি দূরে না গিয়ে কাছাকাছি কোনও বড় হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি।’’

সুদীপবাবুর আরও দাবি, ‘‘স্থানীয় থানা অর্থাৎ শেক্সপিয়ার সরণি থানা আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে ভালই ওয়াকিবহাল। আমরা ওখানে ফোন করি। শেষ পর্যন্ত ওই থানা থেকে বেলঘরিয়া থানাকে ফোন করে রক্তের বিষয়টি বোঝানো হয়। তার পরেই ওঁরা অন্যত্র যান।’’

Advertisement

সুদীপবাবুর সাফাই অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছে দুই থানাই। শেক্সপিয়ার সরণি থানার অফিসাররা স্পষ্টই জানিয়েছেন, এটা নার্সিংহোমের অভ্যন্তরীণ বিষয়। নার্সিংহোমের হয়ে মধ্যস্থতা করাটা তাদের কাজ নয়। আর বেলঘরিয়া থানা এ দিনও নির্দিষ্ট ভাবেই দাবি করেছে, ১০ হাজার টাকা জমা না দিলে ভর্তি না নেওয়ার কথাই বলা হয়েছিল। এক অফিসারের কথায়, ‘‘রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলে আমাদের সেটা না বোঝার কথা নয়। ওঁরা বারবার টাকা চাইছিলেন। এখন নিজেদের দোষ ঢাকতেই এ সব উল্টোপাল্টা দাবি করছে হাসপাতাল। বাচ্চাটির অবস্থা এত খারাপ সেটা যখন ওঁরা বুঝেইছিলেন, তখন এক ঘণ্টা ওকে স্রেফ ফেলে রাখা হল কেন? ওর অবস্থা একটু স্থিতিশীল করার চেষ্টাও তো করা যেতে পারত।’’

বুধবার ট্রাকের ধাক্কায় বাবার মোটরবাইক থেকে ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত অনুরাগ যাদবকে পার্ক ক্লিনিকে নিয়ে এসেছিলেন ডানলপের বাসিন্দারা এবং বেলঘরিয়া থানার পুলিশকর্মীরা। অভিযোগ, দু’তরফের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও নগদ টাকা দিতে না পারায় রক্তাক্ত শিশুটিকে ফিরিয়ে দেয় ওই নার্সিংহোম। আপাতত অনুরাগ ভর্তি রয়েছে এসএসকেএমের অ্যালেক্স ওয়ার্ডে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, তার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। হৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত রয়েছে।

অনুরাগকে ঘিরে এই দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যেই অবশ্য উঠে আসছে আরও একটা বিষয়। অভিযোগ, পার্ক ক্লিনিক একা নয়, টাকা না দিলে ভর্তি না নেওয়ার এই ‘রোগ’ রয়েছে বহু বেসরকারি হাসপাতালেরই। এবং সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে!

মাস কয়েক আগের ঘটনা। লরির চাকা চলে গিয়েছিল এক পথচারীর পায়ের উপর দিয়ে। রক্তাক্ত ওই ব্যক্তিকে নিয়ে অন্য পথচারীরা ছুটেছিলেন বাইপাসের ধারের এক হাসপাতালে। মধ্যরাতে সেই হাসপাতাল সটান জানিয়ে দিয়েছিল, নগদ ১০ হাজার টাকা চাই। তবেই ভর্তি করা হবে আহতকে। সেই রাতে অবশ্য সে কথা শুনে ফিরে যাননি আহতের সঙ্গীরা। হাসপাতালে শুরু হয়েছিল জোর গোলমাল। এর পর ভাঙচুরের উপক্রম হতে কর্তৃপক্ষ ভর্তি নিতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু সে শুধু একটা রাতের জন্য। পর দিন সকালেই দেখা যায়, এক রাতের বিল ৩৫ হাজার টাকা। আর সকালেই তা মিটিয়ে না দিলে রোগীকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত কোনওমতে সেই টাকার অর্ধেক মিটিয়ে সকালেই একটি সরকারি হাসপাতালে আহতকে ভর্তি করেছিলেন তাঁর বাড়ির লোকেরা। পরে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে অভিযোগও দায়ের করেছিলেন তাঁরা। তাঁদের প্রশ্ন ছিল, কেন নগদ টাকা না থাকলে রোগীকে ভর্তি নেবে না হাসপাতাল? আর কোন হিসেবেই বা অস্ত্রোপচার ছাড়া এক রাতে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়?

মাস কয়েক আগের এই অভিযোগের নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। বস্তুত, এমন অভিযোগ স্রেফ জমাই পড়ে থাকে স্বাস্থ্য দফতরে। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত কিংবা আচমকাই বড় ধরনের অসুস্থতার শিকার হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে টাকার অভাবে ভর্তি হতে না পারার এমন বহু অভিযোগ এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য ভবনে জমে রয়েছে। স্বাস্থ্য কর্তারা নিজেরাই মানছেন, অনুরাগ যাদব একা নয়, টাকা না থাকলে মুমূর্ষুকে ফিরিয়ে দেওয়ার এমন নজির ভুরি ভুরি।

বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমগুলি সরাসরি সরকারের অধীনে নয় ঠিকই, কিন্তু তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয় সরকারের তরফেই। আর সেখানেই প্রশ্ন উঠছে— তবে কি এ সব ক্ষেত্রে স্রেফ নীরব দর্শক হয়েই থেকে যাবে স্বাস্থ্য দফতর? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট রোগীর পরিবার অভিযোগ করলে আমরা তদন্ত শুরু করব। শুনানি হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অস্থায়ী, এমনকী স্থায়ী ভাবেও লাইসেন্স বাতিল হতে পারে।’’

গত কয়েক বছরে এই কারণে ক’টি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে? দফতরের খবর, একটিও নয়। আর সে কারণেই বেসরকারি হাসপাতালগুলিও এ ভাবে রোগী ফেরানোর সাহস পায় বলে মনে করছেন অনেকেই।

বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সদস্য রূপক বড়ুয়া বলেন, ‘‘হাসপাতাল এমনই একটা ব্যবসা, যেখানে কিছু মানবিক দিককে গুরুত্ব দিতেই হয়। যে সব ক্ষেত্রে ভর্তির বিষয়টি পূর্ব পরিকল্পিত, সেখানে টাকা নিই। কিন্তু ইমার্জেন্সি কেস-এর ক্ষেত্রে কোনও টাকা না দিলেও চিকিৎসা শুরু হয়। তবে টাকা যে পরে মিটিয়ে দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয়।’’

কিন্তু প্রশ্ন হল, পথ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেখানে রাস্তার অচেনা লোকেরাই হাসপাতালে ভর্তি করতে উদ্যোগী হয়, সেখানে কে মুচলেকা
দিতে রাজি হবেন? রূপকবাবু বলেন, ‘‘সে ক্ষেত্রেও আমরা চিকিৎসা শুরু করে দিই। তার পরে পুলিশকে জানাই যাতে তারা বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যোগাযোগ হলে পরবর্তী কথাবার্তা বাড়ির সঙ্গে হয়। নয়তো পুলিশই সরকারি হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে।’’

একাধিক ভুক্তভোগী অবশ্য জানিয়েছেন, রূপকবাবু যা বলছেন, তা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ম হলেও কার্যত বেশির ভাগ সময়েই সেটা হয় না। যেমন হয়নি পার্ক ক্লিনিকের ক্ষেত্রেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement