মুখোমুখি: বর্ষবরণের রাতে ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার দিয়ে চলছে চালকদের শ্বাস পরীক্ষা। গড়িয়াহাট। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সোমবার রাত। ইএম বাইপাসে চলছে পুলিশের নাকা তল্লাশি। একের পর এক গাড়ি, মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার দিয়ে পরীক্ষা করছেন পুলিশকর্মীরা। সেখানেই দু’টি গাড়ি এবং একটি বাইকের চালককে পরীক্ষা করে এগিয়ে এসে চতুর্থ গাড়ির চালককে কর্তব্যরত পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘পাইপে ঠোঁট লাগিয়ে ফুঁ দিন।’’ হতচকিত চালকের প্রশ্ন, ‘‘এটা করা যায়? অন্যের ঠোঁটে ছোঁয়ানো পাইপ ব্যবহার করতে বলছেন? পুলিশকর্মীর উত্তর, ‘‘বহু লোক ধরতে হচ্ছে। আর পাইপ নেই। এতেই করতে হবে! এমনিতেই লোকে ফুঁ দিলে আমাদের গায়ে সব ছিটছে। আমরাই বা পাইপ ধরব কেন?’’ চালক বললেন, ‘‘তা হলে পাইপটা অন্তত স্যানিটাইজ় করে আনুন।’’ এ বার সেই পুলিশকর্মীর মন্তব্য, ‘‘এখানে স্যানিটাইজ়ার নেই।’’
বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার দিয়ে পরীক্ষার নামে রাতের শহরের বেশ কিছু জায়গায় এমনই কাজ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। কোথাও বলা হচ্ছে, গ্লাভস নেই, তাই অন্যের ঠোঁটে ছোঁয়ানো পাইপ পুলিশকর্মীরা ধরবেন না। কোথাও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যন্ত্র বা পাইপ জীবাণুমুক্ত করার সময় পাচ্ছেন না পুলিশকর্মীরা। কারণ, বার বার যন্ত্র জীবাণুমুক্ত করার সুযোগ নিয়ে নেশাগ্রস্ত অনেক চালক পালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ, বর্ষবরণের রাতেও একই দৃশ্য দেখা গিয়েছে পার্ক স্ট্রিট, হরিশ মুখার্জি রোড বা গড়িয়াহাট মোড়ে। এক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, লাউডন স্ট্রিট এবং পার্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার ব্যবহারের সময়ে দূর থেকে পরীক্ষা করার কোনও চেষ্টাই ছিল না। হরিশ মুখার্জি রোডে এক মোটরবাইক চালকের শ্বাস পরীক্ষা করে ওই পাইপ দিয়েই পরের জনকে পরীক্ষা করতে যাওয়া এক পুলিশকর্মীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘এই পাইপেই হবে। এটাতেই অন্তত চার জনকে ধরব।’’
পুলিশের হিসাব, ৩১ ডিসেম্বর মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য ১৬০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ১ জানুয়ারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৭২ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু আরও কত জন চালকের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে পরিণতি কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা ভেবেই শিউরে উঠছেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই যেমন বললেন, ‘‘এ তো মারাত্মক অপরাধ। এখন যাঁরা সংক্রমিত হচ্ছেন, অধিকাংশেরই কোনও উপসর্গ নেই। ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার দিয়ে এমন কারও শ্বাস পরীক্ষা করে সেই পাইপই অন্য কারও ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলে কী হতে পারে, ভাবা যায় না।’’ চিকিৎসক বিমানকান্তি রায় বললেন, ‘‘এ তো সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক কাজ।’’
প্রায় ২০ মাস বন্ধ থাকার পরে গত নভেম্বরে আবার শুরু হয়েছিল ব্রেথ অ্যানালাইজ়ারের ব্যবহার। কারণ, ওই সময়ে প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’র রিপোর্টে দেখা যায়, কলকাতায় দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মত্ত চালকদের দৌরাত্ম্য। এই পরিস্থিতিতে ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার ফিরিয়ে কলকাতা পুলিশ দাবি করেছিল, এতে নতুন এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। কোনও গাড়িচালক মত্ত অবস্থায় থাকলে তাঁকে পাঁচ সেন্টিমিটার দূর থেকেই চিহ্নিত করা যাবে।
সেই সঙ্গে জানানো হয়, যন্ত্রের গায়ে লাগানো পাইপ এক জন চালকের উপরে ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হবে। প্রতি বার ব্যবহারের পরে জীবাণুমুক্ত করতে হবে যন্ত্র। কিন্তু অভিযোগ, সেই সব নির্দেশিকার কিছুই মানা হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ট্র্যাফিক পুলিশের কর্তারা মন্তব্য করতে চাননি। এক কর্তা শুধু বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্তার যদিও মন্তব্য, ‘‘এমন হওয়ার কথা নয়। তবু ট্র্যাফিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিতে বলব।’’