মালা রায়ের হয়ে প্রচারে কেওড়াতলার ক্লাব। যার উপদেষ্টা স্বপন দে (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।
ব্যবধান ২৫টি গ্রীষ্মের। সে ছিল এপ্রিল, এ-ও এক এপ্রিল। কেওড়াতলা শ্মশান এলাকায় বিতর্ক ফিরে এসেছে আবার সেই পুরনো এক চরিত্রকে ঘিরে!
পোশাকি নাম স্বপন দে। পোশাকি পরিচয়, কেওড়াতলা এলাকায় টালিগঞ্জ রোডে নিছকই একটি ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা। পুলিশের খাতায় খ্যাতি বা কুখ্যাতি অবশ্য ‘শ্মশান স্বপন’ নামে। শ্মশানে শবদাহ ঘিরে অসাধু চক্র থেকে প্রোমোটিংয়ে ঠিকাদারি কেন্দ্রিক গোলমাল, নানা অভিযোগ ছিল তাঁর নামে। জেলফেরত স্বপন আপাতত ফের থিতু হয়েছেন এলাকায়।
এই পরিচয়ও অবশ্য তাঁর আসল ‘খ্যাতি’ নয়! তার সন্ধান পেতে পিছোতে হবে ২৫টি বছর। অস্কারজয়ী, বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যের রাতে কেওড়াতলা শ্মশানের ভিআইপি বিশ্রাম এলাকায় রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন ৩০ বছরের এক যুবক। অধুনা প্রয়াত সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ বিপ্লব দাশগুপ্তের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরেছিলেন। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারদের উপরে চড়াও হয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন কথা বলতে আসতে হবে ‘সাহাদা’কে (তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বীরেন সাহা)! অন্ত্যেষ্টিতে উপস্থিত এক ঝাঁক নামী-দামি ব্যক্তিত্বের সামনে সেই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে শ্মশান থেকেই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছিল জ্যোতি বসু সরকারের পুলিশ। বীরেনবাবুকেও বিতর্কের জেরে পদ হারাতে হয়েছিল, নতুন সিপি হয়েছিলেন তুষার তালুকদার। সে দিনের সেই যুবকই ‘শ্মশান স্বপন’ এবং কালের নিয়মে এখন প্রৌঢ়।
কিন্তু এখন বিতর্ক কোথায়? পুরনো ঘটনার রেশ ঝেড়ে ফেলে এ বার পুরভোটের বাজারে এলাকায় শাসক দলের ছাতার নীচে ঢুকতে চাইছেন সেই স্বপন! কলকাতা পুরসভার ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর এবং তৃণমূল প্রার্থী মালা রায়ের সমর্থনে তাঁকে বার দুয়েক রাস্তায় বেরোতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছেন এলাকার লোকজন! স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেখে তার পরেই অবশ্য প্রকাশ্যে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছেন স্বপন। কিন্তু তাঁর সঙ্গীসাথীদের মাঝেমধ্যেই তৃণমূল প্রার্থ়়ীর সমর্থনে ঘুরতে দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রার্থ়ী মালা অবশ্য দাবি করছেন, এ সবই ‘সস্তা প্রচারে’র উদ্দেশ্যে বিরোধীদের বাজে অভিযোগ। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরের খবর, এত বছর পরে ফের স্বপনের আবির্ভাবে দলের কাছে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক এবং বিধানসভার মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়।
কেওড়াতলা শ্মশান ছেড়ে টালিগঞ্জ রোড ধরে রেলব্রিজের দিকে এগোলেই স্বপনের এলাকা। তাঁর নেতৃত্বে ঘটা করে কালীপুজো সেখানে এখনও হয়। ওই এলাকার একটি ক্লাবই তাঁর বর্তমান আস্তানা। গোটা এলাকা মালার সমর্থনে হোর্ডিং-ফেস্টুনে ছেয়ে দিয়েছে সেই ক্লাব। ওই ওয়ার্ডেরই প্রতাপাদিত্য রোডের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বাড়ির সামনে দিয়ে ক’দিন আগে একটা মিছিলে সেই স্বপনকে আবার দেখে আমরা তো হতবাক!’’ স্থানীয় বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, ২৫ বছর আগের সেই ঘটনার পর থেকেই এলাকাছাড়া ছিলেন স্বপন। সরকার বদলানোর পরে বছরকয়েক আগে ঘরে ফিরেছেন। তবে শাসক দলের শর্ত ছিল, কোনও গোলমালে জড়ানো চলবে না। কিছু সময় যাওয়ার পরেই ঠিকাদারি ঘিরে গোলমালে আবার স্বপনের নাম জড়াচ্ছে দেখে হাত তুলে নেন শাসক দলের কিছু নেতা। স্থানীয় কাউন্সিলর তখন কংগ্রেসে। তিনি তৃণমূলে আসতেই স্বপন আবার ‘সক্রিয়’ হচ্ছেন বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। তাঁদের মনোভাব বুঝে সিপিএমও প্রচারে তুলে এনেছে এলাকাকে ‘সমাজবিরোধীমুক্ত’ করার দাবিকে।
শ্মশানের গায়েই টালিগঞ্জ রোডে থাকেন সোমা দে। বাণিজ্য বিভাগের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া। সত্যজিতের শেষকৃত্যে কী ঘটেছিল, ২২ বছরের সোমা সে সব দেখেননি। কিন্তু যে এলাকায় বেড়ে উঠেছেন, সেখানে এ সব জানতে তাঁর সময় লাগেনি। এ বার ৮৮ ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী হয়ে সোমা তাই সরব হয়েছেন শাসক-সমাজবিরোধী আঁতাঁত নিয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘কাউন্সিলর তো বলেন, তিনি সমাজবিরোধীদের এড়িয়ে চলেন। এখন কী হচ্ছে, সবাই দেখতে পাচ্ছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছি, সমাজবিরোধীমুক্ত এলাকা নিশ্চয়ই সবাই চান। তা হলে আমাদের একটা সুযোগ দিন।’’ সিপিএমের সাহানগর লোকাল কমিটির সম্পাদক সঞ্জীব গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, মালা তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে সাহানগর ইনস্টিটিউশনে তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মালা নিয়ে হাজির ছিলেন স্বপন। সঞ্জীববাবুর অভিযোগ, ‘‘আমরা সাধ্যমতো প্রতিবাদ করছি। আমাদের ছেলেদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ভোটের পরেও সরকার তো থাকবে! তখন দেখা যাবে!’’
তৃণমূল প্রার্থ়ী মালা অবশ্য যাবতীয় অভিযোগই অস্বীকার করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওই রকম কারও (স্বপন) সঙ্গে দল বা আমার সম্পর্ক রাখার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সস্তা প্রচারের জন্য কেউ কেউ এ সব বাজে অভিযোগ করছেন।’’ দীর্ঘ দিনের কাউন্সিলর মালা আরও জানাচ্ছেন, তিনি স্বপনকে চেনেনই না। তবে তাঁর সংযোজন, ‘‘স্বপন এবং শ্রীধর (বলা হয়, স্বপনের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব তাঁর হাতে) দু’জনই আমার এলাকার বাসিন্দা। বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেই তো পারে। যাবে আর কোথায়?’’
তৃণমূলের অন্দরে বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তি কিন্তু যথেষ্ট প্রবল। পঁচিশ বছর আগের সেই ঘটনার দিন স্বপন যাঁদের উপরে চড়াও হয়েছিলেন বলে অভিযোগ, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কলকাতা পুলিশের তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার হায়দর আজিজ সফি। যিনি এখন তৃণমূল সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য! আবার স্বপনের গ্রেফতারির পর দিন আদালতে তাঁর জামিনের জন্য যে তিন আইনজীবী সওয়াল করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। অতীতের ধুলো ঝেড়ে পুরনো বিতর্ক আবার পুরভোটের মুখে ভেসে ওঠার পরে রাসবিহারীর তৃণমূল বিধায়ক শোভনদেববাবু এখন মুখ খুলতেই নারাজ। তবে দলীয় সূত্রের খবর, স্বপনকে সঙ্গে নেওয়ার ব্যাপারে দলের কাছে আপত্তি জানিয়েছেন তিনি। স্থানীয় তৃণমূল ব্লক সভাপতিও একই কথা কর্ম়ীদের জানিয়ে দিয়েছেন। এলাকার এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘দলের ব্যানারে কোনও প্রচারে স্বপন যাচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু ঝান্ডা ছাড়া প্রচারে ওর লোকজনকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। খবর পেয়ে শোভনদা এ সব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।’’ স্বপনের বক্তব্য অবশ্য জানা যায়নি।
সাহাদা-কাণ্ড অতীত। সাহানগরে তবু আবার দানা বাঁধছে পুরনো বিতর্ক!