বিপজ্জনক: এ ভাবেই বন্ধ হয়ে আসা মেট্রো বা লিফটের দরজা আটকানোর চেষ্টা করেন যাত্রীরা। নিজস্ব চিত্র
হাত বাড়িয়ে দিলেই বন্ধ হয়ে আসা লিফট বা মেট্রোর দরজা ফের ‘চিচিং ফাঁক’ হয়ে খুলে যাচ্ছে। তার পরে অনায়াসেই সেঁধিয়ে যাওয়া যাচ্ছে ভিতরে। কিন্তু এ ভাবে হাত-পা বা শরীরের কোনও অংশ বাড়িয়ে লিফট বা মেট্রোর দরজা বন্ধ হওয়া আটকানো একটি ‘বিপজ্জনক প্রবণতা’ বলে মত বিশেষজ্ঞদের। কারণ, দরজায় লাগানো সেন্সর কাজ করবে আর কখন বিকল হয়ে পড়বে, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, কোনও লিফট বা মেট্রোর দরজায় লাগানো সেন্সর আসলে ‘সেফ গার্ড’ বা সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। যাতে কোনও যাত্রী বা কোনও বস্তু দরজার ফাঁকে আটকে গেলে তা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খুলে যায়। কিন্তু প্রায় প্রতি দিনই অকারণে সেই সুরক্ষাকবচ ভুল ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রবিবার পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে মেট্রোয় উঠতে গিয়ে যার খেসারত দিলেন বোসপুকুরের সজল কাঞ্জিলাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক সুগত মুন্সি বলছেন, ‘‘শেষ মুহূর্তে লিফট বা মেট্রোর দরজায় হাত বা শরীরের কোনও অংশ দেওয়া কখনওই উচিত নয়। কারণ, দরজার সেন্সরগুলি সেফ গার্ড হিসেবে কাজ করে। অকারণে সেই সেফ গার্ডকে কাজে লাগাব, এই মনোভাব বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’
কী ভাবে কাজ করে এই সেন্সর? সুগতবাবু জানাচ্ছেন, ধরা যাক কোনও লিফটের দরজায় উপর থেকে নীচ পর্যন্ত একশোটি ‘অপটিক্যাল সেন্সর’ রয়েছে। দরজা বন্ধ হওয়ার সময়ে কোনও কিছুতে বাধা পেলে এই অপটিক্যাল সেন্সর বৈদ্যুতিক সিগন্যালের সাহায্যে ফের সেই দরজা খুলে দেয়। দরজায় আটকে যাওয়া যাত্রীর শরীরের কোনও অংশ যদি দরজার মাঝামাঝি থাকে, তা হলে একশোটি অপটিক্যাল সেন্সরের সবক’টিরই কাজ করার কথা। সে ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যায় সেন্সর একসঙ্গে কাজ করলে দরজাটি খুলে যায়। ‘‘কিন্তু যখন যাত্রীর শরীরের কোনও ছোট অংশ যেমন হাত-পা বা আঙুল দরজায় আটকায়, তখন সবক’টি সেন্সর কাজ করে না। অথবা বলা ভাল, সবক’টির কাজ করার প্রয়োজনও পড়ে না। ধরা যাক সে ক্ষেত্রে মাত্র ১০টি সেন্সর কাজ করল। এখন তাদের মধ্যে যদি কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা যায়, তা হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়!’’— বলছেন সুগতবাবু।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগেরই আর এক শিক্ষক দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, লিফট, মেট্রো বা অন্য জায়গায় থাকা মাইক্রো সুইচ দরজা খোলা-বন্ধ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের প্রোগ্রামিং এমন ভাবেই করা থাকে যাতে সামনে বাধা এলে দরজাটি নিজে থেকেই খুলে যায়। দেবাশিসবাবুর কথায়, ‘‘কিন্তু সেগুলি ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। তাই শেষ মুহূর্তে লিফটে বা মেট্রোয় না ঢোকাই ভাল।’’
ওই বিভাগের শিক্ষক অরিন্দমকুমার শীল আর একটি ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা বলছেন। তিনি জানাচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে যে সেন্সর কোনও বাধাকে (এ ক্ষেত্রে মানব শরীরের কোনও অংশ বা অন্য কোনও জিনিস, কারণ অনেক যাত্রীই হাত বা ব্যাগ বাড়িয়ে দেন মেট্রো বা লিফটের দরজা আটকাতে) শেষ মুহূর্তে ‘ডিটেক্ট’ করল, কিন্তু দরজার মোটর সেই সিগন্যাল ‘রিসিভ’ করতে পারল না। কারণ, তত ক্ষণে দরজার ‘মোটরাইজ্ড গিয়ার অ্যাকশন’ দরজা বন্ধ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে সম্পূর্ণ ভাবে। অরিন্দমবাবুর কথায়, ‘‘সেন্সর বা দরজার মোটরাইজ্ড গিয়ার অ্যাকশনে যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে। তাই কখনওই হাত বা শরীরের অংশ লিফট বা মেট্রোর দরজা বন্ধ হওয়া আটকাতে ব্যবহার করা উচিত নয়।’’
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক পলাশকুমার কুণ্ডুর মতে, এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রতিদিন যান্ত্রিক পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তাতেও অনেক ক্ষেত্রে গাফিলতি থাকে, ফলে দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের আর এক শিক্ষক সায়ন্তন চক্রবর্তীর মতে, লিফট বা মেট্রোর সেন্সর কাজ করছে কি না, তা জানতে ‘ইন্ডিকেটর’ থাকা দরকার। যাতে সেই দরজার সেন্সর বিকল কি না, তা সহজেই বোঝা সম্ভব হয়। সায়ন্তনবাবুর কথায়, ‘‘হাত বাড়িয়ে লিফটের দরজা খোলার থেকে বাইরের বোতাম টিপে দরজা খোলা দরকার। আমরা সেন্সরের উপরে ভরসা করে হাত বাড়িয়ে দিই বটে, কিন্তু বিপদ ঘটতে কতক্ষণ!’’