ফাইল চিত্র।
দোতলা বাড়ির নীচের তলায় ঘরের কোণে বসে বৃদ্ধ। এ ঘরে-ও ঘরে তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজে চলেছেন তাঁর স্ত্রী। বয়সজনিত কারণে তিনিও ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। তা সত্ত্বেও কোনও মতে একের পর এক আলমারি খুলে চলছে ‘তল্লাশি’। বেশ কিছু ক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজির পরে ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে এলেন তাঁরা। হোটেলে ফেরার আগে বৃদ্ধা বললেন, ‘‘তাড়াহুড়োয় স্বাস্থ্য বিমার কাগজ ফেলে গিয়েছিলাম। সেটার জন্যই আসতে হল। বয়স হয়েছে। কখন যে কী হয়, বলা তো যায় না।’’
শনিবারও বৌবাজারের ফাটল ধরা বাড়ির মহল্লায় কেউ এলেন প্রয়োজনীয় নথির খোঁজে, কেউ আবার বিপজ্জনক বাড়ি থেকে বার করে নিয়ে গেলেন আসবাবপত্র এবং শখের নানা জিনিস। বাড়ির ফাটল আরও বাড়ল কি না, অনেকে আবার এ দিন সেই খোঁজ নিতেও এসেছিলেন দুর্গা পিতুরি লেনে। সেই সঙ্গে পুলিশের ব্যারিকেড এবং মেট্রোকর্তাদের তদারকি ও পরিদর্শন— সবই দেখা গেল দিনভর।
মেট্রো কর্তৃপক্ষের ঠিক করে দেওয়া রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের হোটেল থেকে সকালে এসেছিলেন বছর ৬৭-র আশিস চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী নমিতা চৌধুরী। অসুস্থতার জেরে ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না আশিসবাবু। ধরে ধরে নিয়ে যেতে হচ্ছিল তাঁকে। একটু হেঁটেই খানিক বিশ্রাম নিতে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। দুর্গা পিতুরি লেনে দাঁড়িয়ে আশিসবাবু জানালেন, মাসখানেক আগেই বড় অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। তার পরে মেয়ের কাছে চলে গিয়ে ছিলেন। কিছু দিন আগেই সেখান থেকে ফিরেছেন। জানা গেল, ওই প্রবীণ দম্পতিকে দেখাশোনার তেমন কেউ নেই। একমাত্র মেয়ে হলদিয়ায় থাকেন। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার খাওয়াদাওয়া হোম ডেলিভারি-নির্ভর। তবে হঠাৎ কোনও প্রয়োজনে প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসতেন।
বৃদ্ধের কথায়, ‘‘সে দিন পড়িমরি করে বাড়ি ছেড়েছিলাম। কিছু জিনিসপত্র খুঁজে বার করে যে সঙ্গে নেব, সেই সময়টুকুও পুলিশ দেয়নি। কিছু জামাকাপড় নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মাথার উপরের ছাদটাই চলে গেল। বিপদে-আপদে যাঁরা সব সময়ে দৌড়ে আসতেন, তাঁরাও এ দিক-ও দিক ছড়িয়ে গিয়েছেন। এই অবস্থায় যদি স্বাস্থ্য বিমার কাগজপত্রও সঙ্গে না রাখি, তা হলে তো মুশকিলে পড়তে হবে! তাই হোটেল থেকে কষ্ট করেই চলে এলাম।’’ নমিতাদেবী জানালেন, দোতলা বাড়ির নীচের তলায় তাঁরা থাকতেন। উপরে থাকতেন ভাড়াটে। তাঁর কথায়, ‘‘দু’জনের কেউই তো ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারি না। একটু ধকল হলেই নানা সমস্যা হয়। তার মধ্যে এই ভোগান্তি। আর যে কত দিন এ সব পোহাতে হবে!’’
শুধু তাঁরাই নন, এ দিন পুলিশের বিধিনিষেধ এড়িয়ে কিছু ক্ষণের জন্য ঘরে ঢুকেছিলেন রাজকুমার চৌরাসিয়া, শমিতা চৌরাসিয়া, বিশ্বজিৎ ঠাকুর-সহ আরও অনেকে। ব্যাগে বেশ কিছু জিনিসপত্র ভরে নিয়ে গেলেন তাঁরা। কয়েক জন আবার জিনিসপত্র কোনও পরিচিতের বাড়িতে রেখে এলেন। ঘরে তালা দিতে দিতে তাঁদেরই এক জন বলে উঠলেন, ‘‘ফের ভবঘুরের জীবন শুরু হল! এর শেষ কবে, কে জানে!’’