প্রতিদিনের মতোই মোটরবাইকে একে অপরের কোমর জড়িয়ে বসে ছিল ওরা। অন্য দিন স্কুলের গেটে পৌঁছে নামার সময়ে হাত সরায়। কিন্তু বুধবার সকালে স্কুলে আর পৌঁছনো হয়নি। হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে তার আগেই। এবং শেষ বারের মতো।
ওলটপালট করে দিল একটা ট্রেলার। স্কুলের কয়েকশো মিটার দূরে মোটরবাইকের পিছনে আচমকা ধাক্কা। বাইক থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়েছিল অনিকেত যাদব, সঞ্জনা যাদব ও অনুরাগ যাদব। সঙ্গে অঙ্কিত ও অনুরাগের বাবা বিশ্বনাথ যাদবও। নিমেষে রক্তে মাখামাখি। তার মধ্যেই অচেতন হয়ে পড়ে তিন শিশুই। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরেও সেই দৃশ্য ভুলতে পারছিলেন না খিদিরপুর ডকের কর্মী বিশ্বনাথবাবু। পা ও পিঠের চোটে ব্যথা মোচড় দিয়ে উঠছে মাঝেমাঝেই। আর কান্নায় ভেঙে পড়ছেন যুবক। বলছেন— ‘‘সব ব্যথা কমে যাবে। বুকের যন্ত্রণাটা কমাব কী করে?’’
আড়িয়াদহ ডি ডি মণ্ডল ঘাট রোডেই যৌথ পরিবার জগলাল যাদবের। তাঁরই মেজ ছেলে বিশ্বনাথ। পরিবারের বাকি ছেলেমেয়েরা বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে পড়াশোনা করলেও তিন খুদে পড়ত ডানলপ মোড়ে এক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। রোজকার মতো এ দিন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ নিজের দুই ছেলে ও বড় দাদা শম্ভুর ছোট মেয়ে সঞ্জনা ওরফে ববিকে মোটরবাইকে চাপিয়ে সেখানেই যাচ্ছিলেন বিশ্বনাথ। রোজই মোটরবাইকের সামনে বসত অনুরাগ। আর বিশ্বনাথবাবুর পিছনে সঞ্জনা ও অনিকেত। এ দিনও সকালে ঠিক সে ভাবেই বসে বাড়ির সকলকে ‘টাটা’ করে বেরিয়েছিল তিন জন।
তার পরে ঠিক আধ ঘণ্টা। ৯টা বাজতেই বাড়ি এসে পৌঁছল ভয়ঙ্কর খবরটা। বাড়ির সকলে ছুটলেন বেলঘরিয়া রথতলার বেসরকারি হাসপাতালে। ততক্ষণে মারা গিয়েছে অনিকেত ও সঞ্জনা। কাকা রাজেশ বলছিলেন, ‘‘বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, ওরা আর নেই।’’
হাসপাতাল থেকে ফিরে বাড়ির উঠোনেই বসে পড়েছিলেন ঠাকুরদা জগলাল। তাঁর সঙ্গে ভারী ভাব ছিল তিন জনেরই। একনাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘‘আমাকেই তো নিতে পারত উপরওয়ালা!
ফুলের মতো বাচ্চাগুলো কী দোষ করেছিল!’’ খবরটা ছড়িয়ে পড়তে বাড়িতে তখন ভিড় করেছে গোটা পাড়া। পৌঁছে গিয়েছেন যাদব পরিবারের আত্মীয়েরাও। সকলের চোখেমুখে তখনও অবিশ্বাস। প্রতিবেশী ঝর্না ভৌমিক বলছিলেন, ‘‘বাচ্চাগুলো এত মিষ্টি! ববি তো সবাইকে ডেকে ডেকে কথা বলত। কাপড় টেনে ধরত!’’
বাড়ির উঠোনে কান্নায় লুটিয়ে পড়ছিলেন অনিকেতের মা লক্ষ্মী যাদব ও সঞ্জনার মা মায়া যাদব, ঠাকুরমা কমলাদেবী। মুখে শুধু একটাই কথা, ‘‘আমাদের এই সর্বনাশ কেন হল?’’ উত্তর ছিল না আশপাশের কারও কাছেই। নীরবে চোখের জল ফেলেছেন তাঁরাও।
আর ঘুরেফিরে এসেছে অনিকেত
আর সঞ্জনার কথা। প্রতিদিন বিশ্বনাথের সঙ্গেই নিজের মোটরবাইকে মেয়েকে চাপিয়ে বেরোন প্রতিবেশী গৌর সাহা। ‘‘আজ আমার খানিক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল বিশু। আমরাও বেরোতে যাব, তখনই খবরটা এল!’’
বেলার দিকে ওই বাড়িতে যান সঞ্জনার ক্লাস টিচার যশবীর কৌর। তাঁকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন মায়াদেবী। কাঁদছিলেন শিক্ষিকাও, ‘‘খুব শান্ত মেয়ে ছিল সঞ্জনা। স্কুলের ফাংশনে নাচে অংশ নিতে পারবে কি না, আমার কাছে গতকালই জানতে চেয়েছিল। ফাংশনে আর নাচা হল না ওর।’’
সকলের চোখের আড়ালে তখন ভাই অনিকেতের স্কুলের ব্যাগটা জড়িয়ে বসে সঞ্জনার দিদি নিশা। চোখ ভর্তি জল। সামনে যেতেই আকুল প্রশ্ন, ‘‘কাকু, ওরা আর আসবে না?’’