Fermented Rice

ভোট বা গরমে পান্তার শরণাগত বাঙালি

শহরের পাইস হোটেল থেকে পাঁচতারায় আজকাল নিদাঘ দিনে টক ডাল থেকে ট্যালটেলে কবিরাজি ঝোলের বান। পান্তাচর্চা এখনও কলকাতায় তত প্রবল নয়। তবু তপ্ত বৈশাখে শহুরে পাস্তাকে চ্যালেঞ্জ ছু়ড়ছে পান্তা।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩২
Share:

বাঁশদ্রোণী এলাকায় খাবার উৎসবে পান্তা ভাত। —নিজস্ব চিত্র।

সুদূর কৈলাসে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময়ে মেয়ে উমাকে দু’টি পান্তা খাইয়ে দিতে হবে। লম্বা সফরের আগে ঠান্ডা-ঠান্ডা আহার। পুরীর মন্দিরের প্রতিহারী রঘুনাথ গোচিকার বললেন, ‘‘শুধু সমারে (গ্রীষ্মকাল) নয়, প্রভু জগন্নাথের সারা বছরই শয়নের আগে পখালা (পান্তাভাত) চাই। টক-টক জল-ঢালা ভাত খেলে ঘুমটা ভাল হবে।’’ শয়নের আগের ফুলসাজ বা বড় শৃঙ্গার বেশ ধারণের পরে জগন্নাথদেব রোজ পান্তা ভাতে দই, আদা, ভাজা মশলাগুঁড়ো মিশিয়ে খাবেন। সঙ্গে কাঁচকলার বড়া। রোদে পোড়া, হা-ক্লান্ত শুকনো জীর্ণ কলকাতাতেও এখন করুণাধারার মতোই নেমে আসছে পান্তা। সৌজন্যে জৈব খাদ্য এবং বাংলার হারিয়ে যাওয়া চাল বিপণনের মঞ্চ পৌষ্টিক লাইফ। আবার টালা পার্কে সন্দেশখালির মেয়েদের এনেও কালো মোটা চাল বা হলুদ বাটালি চালের পান্তা সাজানো হয়েছে।

Advertisement

নানা কিসিমের পান্তাকে জৈব খাদ্য না-বলে দৈব খাদ্য বলাই যায়। অন্তত এ গরমে পান্তাভাত যেন সাক্ষাৎ দৈব খাদ্যই। মাস্টারদা সূর্য সেন স্টেশনের কাছের পৌষ্টিক লাইফে সুলেখক রসনাবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্ত এবং রান্নাপাগল তরুণ রোহিতাশ্ব তূর্য জোট বেঁধে বাঙালির পান্তাচর্চার ঐতিহ্য, ইতিহাস খুঁড়ে আনতে নেমেছেন। তাতে বার বারই চলে আসছে শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে রবীন্দ্রনাথের অনুষঙ্গও। গর্ভাবস্থায় রামকৃষ্ণের জননী চন্দ্রাদেবী হাঁসের পিঠে চড়া এক ঠাকুরের দিব্য দর্শনে মায়ায় কাতর হয়েছিলেন। রোদে পুড়ে ঠাকুরের মুখ লাল। হাঁসে চড়া ঠাকুরকে দু’দণ্ড জিরিয়ে ঘরের আমানি, পান্তা খেতে বলেছিলেন চন্দ্রাদেবী। আমানি শব্দটি সম্ভবত অম্লপানি থেকে এসেছে। ২৪ ঘণ্টা ধরে মজানো পান্তার টক-টক জল। দীপঙ্কর, তূর্য এবং পৌষ্টিক লাইফের সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, রুথ চট্টোপাধ্যায় মিলে অতিথিদের জন্য পান্তা ভাতের মেনু করতে বসে বাঙালি মনীষীদের পুরনো সব গল্প মনে করছিলেন। জয়রামবাটিতে শ্বশুরবাড়িতে রামকৃষ্ণ এক রাতে হঠাৎ খিদেয় কাতর। পড়ে থাকা পান্তাভাত এবং মাছ-চাটুইয়ের তলানি আস্বাদে আকুল হয়ে ওঠেন। দীপঙ্করের পরিকল্পনায় এই মাছ-চাটুইয়ের প্রেরণায় তূর্ষ মৌরলা মাছের গা-মাখা রসা রেঁধেছেন। বালক রবীন্দ্রনাথও স্কুল থেকে ফিরে নতুন বৌঠান কাদম্বরীদেবীর হাতের পান্তাভাত ও চিংড়ির ঝাল
চচ্চড়ি খেতেন। তা-ও ঢুকেছে পান্তার মেনুতে।

শহরের পাইস হোটেল থেকে পাঁচতারায় আজকাল নিদাঘ দিনে টক ডাল থেকে ট্যালটেলে কবিরাজি ঝোলের বান। পান্তাচর্চা এখনও কলকাতায় তত প্রবল নয়। তবু তপ্ত বৈশাখে শহুরে পাস্তাকে চ্যালেঞ্জ ছু়ড়ছে পান্তা। সমাজমাধ্যমে অনেকেই পান্তার গুণগান গাইছেন। হোমশেফ জয়িতা ঘোষ বা তানিয়া মাইতির মতো কেউ কেউ পান্তাভাতের পসরা পৌঁছে দিচ্ছেন। তবে জয়িতা বলছিলেন, ‘‘কলকাতায় অনেকেরই প্রকৃত পান্তার বিষয়ে ধারণা নেই। তারকেশ্বরে আমাদের গ্রামে গরুর খড়ের ঘরের পাশে পান্তা মজানো হত। তবে ২৪ ঘণ্টা মজানো পান্তার জলের গন্ধটা সবার পোষাবে না, এটা মাথায় রাখছি।’’

Advertisement

তূর্যও নিজের বাড়ির ধারা মেনে সাধারণত ১২ ঘণ্টা পান্তা মজান। তাঁদের পান্তা আসরে ঢেঁকি-ছাটা ভাদই চালের পান্তা রাখা হয়েছিল। বাঁকুড়ার কলমকাঠি, ভূতমুড়ির মতো দুর্লভ চাল বা কেরালাসুন্দরী চালেও ভাল পান্তা হবে, বলছেন সুদীপ। দীপঙ্করের মতে, ‘‘সুগন্ধি, সরু চালের ভাত পান্তায় জমবে না। সাধারণ মোটা চালের ভাতই ভাল। পাতে কোনও পোড়া, বাটা বা কুড়মুড়ে ভাজা ভাল লাগবে।’’ বৃদ্ধ বয়সেও বাঙালির ‘পকেট-হারকিউলিস’ মনোহর আইচের মুখের কথাই ছিল, ‘পান্তাভাতের জল, তিন মানুষের বল’। দেখা যাচ্ছে, ভোট-আবহে প্রচারের ধকল সইতে প্রার্থীরাও অনেকে পান্তার শরণাপন্ন। পেট ঠান্ডা হল, আবার নিজেকে ‘আমি তোমাদের লোক’ প্রমাণও করা গেল। গরম ও গণতন্ত্র— দু’টিতেই স্বাস্থ্যকর পান্তা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement