পার্বণী সুখাদ্যের সন্ধানে আলাউদ্দিনের দরবারে

ফিয়ার্স লেনে কলুটোলার মোড়ের মুখের এই মিষ্টি-বিপণি নিউ মার্কেটের নাহুমের সমবয়সি। জন্মলগ্ন ঠিক কবে, নিখুঁত ভাবে বলা মুশকিল।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৯ ০১:২৬
Share:

মিষ্টান্ন: আলাউদ্দিনে রমজানের সম্ভার। রবিবার, জ়াকারিয়া স্ট্রিটে। নিজস্ব চিত্র

পোশাকি নাম যা-ই থাক, ‘ইনি’ হলেন রমজানের ‘জলভরা’!

Advertisement

ধারে বিনুনি পাকানো গোলাকার ময়দার খোলে দাঁত বসালে অত এব সাবধান! জ়াকারিয়া স্ট্রিট-কলুটোলা তল্লাটে ইফতারি সুখাদ্য সন্ধানে হাজির হয়ে অমন বেমক্কা কামড়ালে বিপদ। অবধারিত আপনার শার্ট বা টপ চ্যাটচেটে রস পড়ে নষ্ট! পেটমোটা ময়দার খোলে ঠাসা রসালো ক্ষীরে বিক্ষিপ্ত কিসমিস। খাঁটি ঘিয়ের সুরভিময় এই খাস্তা মিষ্টির নাম ‘মাওয়া কা কচৌরি’! সাকিন, ‘হাজি আলাউদ্দিন’।

ফিয়ার্স লেনে কলুটোলার মোড়ের মুখের এই মিষ্টি-বিপণি নিউ মার্কেটের নাহুমের সমবয়সি। জন্মলগ্ন ঠিক কবে, নিখুঁত ভাবে বলা মুশকিল। তবে নথি বলছে, ১৯০৪ থেকে আজকের ঠিকানায় ওঁরা স্থিত রয়েছেন। রমজানের এই মাসটা জ়াকারিয়া স্ট্রিট-কলুটোলা চত্বর যখন সন্ধ্যায় পুজোর ম্যাডক্স স্কোয়ার হয়ে ওঠে, তখন এই ‘আলাউদ্দিন’কে এ তল্লাটের বাদশা বা সব থেকে বড় উস্তাদ শিল্পী বলা যেতেই পারে। হালিম তবু রমজানের পরেও কলকাতার দু’-একটা জায়গায় পাওয়া যায়, কিন্তু শহরের শতাব্দী-প্রাচীন মিষ্টি স্রষ্টার কয়েকটি বাছাই উৎকর্ষ এই একটি মরসুমেই মেলে।

Advertisement

গ্লুটেনমুক্ত ডায়েটের শৃঙ্খলা বা রক্তে শর্করার ভয়টয় ভুলে এ হল, ঘি-ময়দার খাস্তা যুগলবন্দিতে সমর্পণের মঞ্চ। মাওয়া কা কচৌরির ক্ষীরের পুর আস্বাদের আগে-পরে ‘নোনতা মুখ’ করতে হলেও আলাউদ্দিন লা-জবাব। পেরাকির আদলে অর্ধচন্দ্রাকার ‘সামোসা’ এমনিতে কলুটোলা-ফিয়ার্স লেন বা খিদিরপুর-রিপন স্ট্রিটে সারা বছরই বিকোয়। ভিতরে মাংসের নামমাত্র পুরে চরম ফাঁকিবাজির নমুনা। সারা বছরের অতৃপ্তি ঘোচাতেও আলাউদ্দিনের মাটন বা চিকেন সামোসা ভরসা। ঠাসা মাংসের কিমার পুরে কাঁচা লঙ্কাকুচির মার্জিত প্রখরতা। ঘি-টা গুরুপাক হলেও লুচিপ্রেমী বাঙালি হিসেবে খোলটার অংশও ফেলতে কষ্ট হয়। এ মরসুমে তাঁদের অমৃতিটাও সম্ভ্রমযোগ্য। ঢাকাই অমৃতির থেকে সাইজে একটু ছোট! আদর্শ অমৃতিসুলভ খাস্তা, কিন্তু কুড়মুড়ে নয়। ঘিয়ের সুঘ্রাণ যথারীতি ভুরভুর করছে।

দোকানের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন সাহেবের ছোট পুতি হাম্‌দ সুলতান সদ্য লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে ‘মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনস’-এর পাঠ নিয়ে ফিরেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘‘বছরভর যা ব্যবসা হয়, তার অর্ধেকের বেশি রমজানের মাসেই। আগে কলকাতার কয়েকটি অঞ্চলের লোকেই বেশি আসতেন। বছর দু’-তিন হল বাঙালিদেরও দারুণ ভিড়।’’ তবে ইফতারির উৎকর্ষের খোঁজে সন্ধে পার করে ফেললে কিন্তু সমস্যা! এ সব পরম কাঙ্ক্ষিত বস্তু আকছার বিকেল চারটে-পাঁচটার মধ্যেই খাঁ-খাঁ করে।

বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে বোহরা মুসলিমদের দোকান ‘বম্বে সুইটস’ বন্ধ হওয়ার আক্ষেপ কিছুটা মেটে এখানে এলে। গুলাবজামুন, মাওয়া লাড্ডু, মতিচুর লাড্ডুগোছের মিষ্টি ছাড়া নানা কিসিমের হালুয়ার পরম্পরা আলাউদ্দিন এখনও ধরে রেখেছে। নারকোলের বরফি, কাজু বরফি, দুধের হালুয়া, করাচি বা মুসকাট হালুয়া, কালাকাঁদে উত্তর ভারত ও কলকাতার পরম্পরা একাকার। মাওয়া, কাজু-সহ ৩২ রকম উপকরণের মিশেলে ‘বাত্তিসি হালুয়া’ নাকি দারুণ স্বাস্থ্যকর। ফিয়ার্স লেনে আদমের বিখ্যাত সুতা কবাবের জন্য রমজানের লম্বা লাইন যেখানে শেষ হয়েছে, তার অনতি দূরেই এই মিষ্টি ক্ষেত্র। ইদের প্রাক্কালে এ দোকানের আর একটি পরম্পরা, চাঁদ রাতের (ইদের আগের সন্ধ্যা) আগে থেকে ইদের বিকেল অবধি টানা ৪৮ ঘণ্টা কখনওই ঝাঁপ বন্ধ হবে না।

বছরের অন্য সময়ে রসগোল্লা-সন্দেশের মতো ছানার মিষ্টি ওঁরা করলেও ইদের সময়টা বরফি-হালুয়ারই রমরমা। থাকা-খাওয়ার পদে পদে জাতধর্মের খড়ির দাগ টানাই এ যুগের দস্তুর। সেখানে স্বাদের টানেই গোটা কলকাতাকে মিলিয়ে দিচ্ছে জ়াকারিয়া-কলুটোলা চত্বর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement