চার বার চক্কর কেটেও ঠাঁই হল না

প্রেসক্রিপশনে ইংরেজিতে লেখা এই চারটি শব্দ ওঁরা ঠিক মতো পড়তেও পারেননি। কিন্তু বিভিন্ন দরজায় ঠোক্কর খেতে খেতে গত দু’মাসে সেই অক্ষরের মর্ম বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার মফিজুল বিশ্বাসের পরিবার। 

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৩১
Share:

অসহায়: শয্যা ফাঁকা নেই। বৃহস্পতিবার ফের আর জি কর থেকে ফিরে গেলেন মফিজুল বিশ্বাস। ছবি: সুমন বল্লভ

‘রিগ্রেট, নো বেড ভেকেন্ট’।

Advertisement

প্রেসক্রিপশনে ইংরেজিতে লেখা এই চারটি শব্দ ওঁরা ঠিক মতো পড়তেও পারেননি। কিন্তু বিভিন্ন দরজায় ঠোক্কর খেতে খেতে গত দু’মাসে সেই অক্ষরের মর্ম বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার মফিজুল বিশ্বাসের পরিবার।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা এসএসকেএম-এর রোগী ফেরানোর ‘সংক্রমণ’ থেকে যে আর জি করও মুক্ত নয়, বৃহস্পতিবার হাসপাতাল চত্বরে আনন্দবাজারের দিনভরের অভিজ্ঞতা সেটাই বলছে। ঘড়িতে তখন দুপুর আড়াইটে। ইমার্জেন্সির সামনে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন বছর চল্লিশের এক রোগী। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দু’-তিন জন আত্মীয়। কী হয়েছে? প্রশ্ন করতেই এক জন হাতে ধরিয়ে দিলেন, একটি প্রেসক্রিপশন। তাতেই শয্যা না থাকার কথা লেখা রয়েছে। জানা গেল, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার শ্যামনগর গ্রাম থেকে এসেছেন মফিজুল নামের ওই রোগী। কোমরের জরুরি অস্ত্রোপচারের তারিখ পেতে গত দু’মাস ধরে তিনি আর জি করে চার বার হত্যে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে শয্যাশায়ী হয়ে পড়া ওই দিনমজুরের বেডসোর হয়ে গিয়েছে। এ দিনও অস্ত্রোপচারের তারিখ মেলেনি। কাতরাতে থাকা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফেরার তোড়জোড় করছিলেন দিদি।

Advertisement

বছর পাঁচেক আগে এই হাসপাতালেই অস্ত্রোপচার হয়েছিল মফিজুলের। গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কোমরের নীচের ডান দিকের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। অস্ত্রোপচার করে প্লেট বসাতে হয়েছিল সে সময়ে। দু’মাস আগে সেই জায়গাটি আচমকাই ফুলে উঠতে শুরু করে। সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। আর জি করে দেখাতে এলে চিকিৎসকেরা জানান, প্লেট খুলে গিয়েছে। এখন ওই ফোলা অংশে বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না হলে বড় ধরনের সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।

তাজমিরা বিবি (মফিজুলের দিদি):

এই নিয়ে হাড়োয়া থেকে চারবার আর জি করে এলাম। প্রতি বার ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা দিনমজুর পরিবার। এমনিতেই এখন কোনও রোজগার নেই ওর। কোমর ভাঙা মানুষকে নিয়ে মোটা টাকা খরচ করে কতবার আর আসতে হবে বলতে পারেন? এ দিন ডাক্তারবাবুদের কাছে অনেক মিনতি করেছিলাম, ভাইটাকে ভর্তি করিয়ে নেওয়ার জন্য। ওঁরা বললেন, বেড নেই, তাই কিছু করার নেই।

রাকেশ মণ্ডল (মফিজুলের ভাগ্নে):

হাড়োয়া থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে আসতে খরচ পড়ছে দু’হাজার টাকা। ভাবতে পারেন, একটা বেকার মানুষকে কী ভাবে ওই টাকার

ব্যবস্থা করতে হচ্ছে! ট্রলি চাইতে গেলাম, সেখানে মোবাইল অথবা আধার কার্ড জমা দিতে বলল। তাই পাঁজাকোলা করে মামাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আজও ভর্তি করা যাবে না শুনে ওঁকে অ্যাম্বুল্যান্সে রেখে সুপারের কাছে গেলাম। নিরাপত্তারক্ষীরা ঢুকতেই দেননি। অনেক অনুরোধ করলাম। বললেন, সুপার দেখা করবেন না। এর আগেও সুপারের দেখা পায়নি। বেসরকারি হাসপাতালে মামাকে ভর্তি করা তো সম্ভব নয়। তবে আর কত বার ঘুরলে তারিখ মিলবে!

এ দিন আনন্দবাজারের তরফে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপার মানস বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আপনার সঙ্গে কোনও কথা বলব না। রোগীকে দেখা করতে বলুন।’’ তাঁকে জানানো হল, রোগীর পরিবার তাঁর দরজা পর্যন্ত পৌঁছলেও, তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা হলে তাঁরা দেখা করবেন কী ভাবে? তার উত্তর দেননি সুপার।

এ প্রসঙ্গে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যাল এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রকে ফোন করা হলে তাঁরা ফোন ধরেননি। এমনকি দু’জনেই মেসেজেরও উত্তর দেননি।

এ দিকে, বুধবার এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে ভর্তি হতে না পেরে ফিরে যাওয়া বছর চুরাশির বাদল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থা বৃহস্পতিবার বেশ খারাপ হয়েছে। তাঁর নাতি অপূর্ব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাড়িতেই দাদুর স্যালাইন চলছে। আমরা সব আশা ছেড়ে দিয়েছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement