একেকটি মৃত্যু বহু সময়েই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে থেকে যায় না। বরং সেই মৃত্যু তুলে আনে নানা প্রশ্ন। সমস্ত পর্দা সরিয়ে এক ঝটকায় বেআব্রু করে দেয় কিছু অপ্রিয় সত্য। দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুলের পড়ুয়া, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাও অনেকটা তেমনই।
বন্ধুর সঙ্গে গোলমালের জেরে ১১ বছরের কোনও ছেলে বা মেয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে— এমন নজির কি খুব বেশি মনে করতে পারে এই শহর? উত্তরটা যদি ‘না’ হয়, তা হলে প্রশ্ন, কেন এমন ঘটল? অস্থিরতা তা হলে সমাজের কোন স্তরে? ঠিক কোন অনিশ্চয়তার বোধ থেকে বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় থাকা একটি মেয়ে এমন চরম পথ বেছে নিতে পারে? তা হলে কি আরও বেশি সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে অভিভাবকদের?
মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরেই তাঁদের চেম্বারে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ভিড় বাড়ছে। এদের মধ্যে অনেকেরই আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। তাদের সঙ্গে কথা বলে, যন্ত্রণা-অস্থিরতার উৎস খুঁজে সেই প্রবণতার উপশম ঘটাতে হয়।
মনোবিদেরা মনে করেন, বন্ধু বা সমবয়সী সঙ্গীদের থেকে নানা চাপ এখন শিশুমনকে বেশি প্রভাবিত করছে। ছোটবেলা থেকেই ওই সব সম্পর্কের ওঠাপড়া তাদের জীবনে ছাপ ফেলছে। আসছে আত্মহত্যার চিন্তাও। কারণ, চাপটা তারা কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারছে না। ধরেই নিচ্ছে, তাদের সঙ্কট বাকিরা বুঝবে না। মনোবিদ রিমা মুখোপাধ্যায়ের মতে, এখানেই বাবা-মায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি যদি তাদের মন ভাল থাকা-না থাকা নিয়েও বাবা-মায়েরা ভাবেন, তা হলে সঙ্কট অনেক কমে। তিনি বলেন, ‘‘স্কুল থেকে ফেরার পরে ছেলেমেয়ের চোখ-মুখ দেখেই আন্দাজ করা যায় যে, তারা বিপর্যস্ত কি না। অমুক স্যার বা তমুক ম্যাম কী পড়ালেন, সেটা জানা যেমন জরুরি, তেমনই বন্ধুদের সঙ্গে সে কেমন সময় কাটাল, তার খোঁজ নেওয়াও দরকার। তার আনন্দের জায়গা, দুঃখের ক্ষত— দুটোই বুঝতে হবে।’’
মনোবিদদের একটা বড় অংশ তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে মনে করেন, অভিভাবকদের বোঝার জায়গাতেই ঘাটতি থাকছে। আগে যৌথ পরিবারে ছেলেমেয়েরা অনেকের সঙ্গে অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারত। এখন বাবা-মা আর সন্তান। নিজের অনেক মানসিক সঙ্কটেই সন্তান মনে করছে, ‘বাবা-মাকে বলে লাভ নেই। ওরা বুঝবে না।’ অভিভাবকদের চ্যালেঞ্জটা এখানেই।
ইদানীং এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য চালু হয়েছে ‘পেরেন্টাল কাউন্সেলিং’। বিদেশে বহু দিন ধরেই এটা চালু। এ দেশে তো বটেই, এমনকী এই শহরেই এমন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। সেখানে মূল শিক্ষণীয় বিষয়ই হল, কী ভাবে আর একটু সংবেদনশীল বাবা-মা হওয়া যায়। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ মনে করেন, সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের মানসিক সেতুটা শৈশব থেকে জোরদার হওয়া দরকার। ‘ইমোশনাল ব্যালেন্সিং’ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্য-ব্যর্থতার পাশাপাশি সন্তান যেন বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের ওঠাপড়াও বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। পায়েলের কথায়, ‘‘শুধু ভিডিও গেমস, টিভি সিরিয়াল নয়, শিশুদের মধ্যে ভাল কিছু ‘হবি’ তৈরি করাও খুব জরুরি। এখনকার শিশুরা আগের তুলনায় অনেক কিছু বেশি জানে। তাদের ‘এক্সপোজার’ অনেক বেশি। তাই তাদের মনটাকে গঠনমূলক দিকে, ইতিবাচক দিকে চালিত করার দায়িত্বটাও বাবা-মায়েরই।’’