প্রতীকী ছবি
আশা ছিল, লকডাউন উঠলেই কাজে ফেরা যাবে। কিন্তু অভিযোগ, আনলক-১ শুরুর পরে প্রায় সব সংস্থা খুলে গেলেও অনেকেই এখন কর্মহীন হচ্ছেন স্রেফ লোকাল ট্রেনে কলকাতায় পৌঁছতে না পারায়। কোনও সংস্থা তাদের বাইরে থেকে আসা এমন কর্মীদের কোনও সংস্থা বলে দিচ্ছে, “ট্রেন চললে যোগাযোগ করবেন। সুযোগ থাকলে জানানো হবে।” কোথাও জানানো হচ্ছে, লোকাল ট্রেনের ভিড় থেকে সংক্রমণ এড়াতে কলকাতার ছেলে-মেয়েদেরই কাজে নেওয়া হবে। লকডাউনের দু’মাসের মতো চলতি মাসের বেতনও পাননি তাঁরা।
শহরের একটি নামী বেসরকারি সংস্থায় নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন বজবজের শ্যামল সরকার। তিনি বলেন, “কাগজের মাথায় ‘আউটসাইডার’ লিখে অফিসে আমাদের মতো ট্রেনে যাতায়াতকারীদের একটি নামের তালিকা তৈরি হয়েছে। নাম ধরে ধরে ফোন করে বলে দেওয়া হয়েছে, অফিস খুললেও আসার আর দরকার নেই। পরে লাগলে ডাকা হবে।” পরে কবে, তা অবশ্য জানেন না বছর একান্নর শ্যামলবাবু। তবু বলেন, “অফিস বলেছে, ট্রেন চালু হয়ে যাওয়ার পরের দু’মাসও আসা বারণ।”
পাঁচ নম্বর সেক্টরের এক বেসরকারি সংস্থার ব্যাক অফিসের কর্মী গোবরডাঙার বাসিন্দা চন্দন সেন লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় লকডাউনের মধ্যেও মার্চের শেষ থেকে মোটরবাইকেই অফিস যেতেন। বাড়ি থেকে চার ঘণ্টা যাতায়াতের জন্য প্রতিদিন ২২০ টাকার পেট্রল পুড়ত তাঁর। ২৭ এপ্রিল তাঁকে জানানো হয়, আপাতত এত দূর থেকে যাতায়াতের দরকার নেই। কারণ বাইকে অনেকগুলি এলাকা পেরিয়ে আসায় তাঁর থেকে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি প্রবল!
চন্দনের কথায়, “বাবার রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে। ২০ হাজার টাকা বেতনের ১৪ হাজারই মায়ের হাতে তুলে দিতাম। তিন মাসের বেতন পাইনি। ট্রেন চললেও আর নেবে বলে মনে হয় না।”
জেলা থেকে ট্রেনে যাতায়াতকারী এমন ৬০ শতাংশ কর্মীকে ছাড়াই গত সোমবার থেকে খুলেছে শহরের শপিং মলগুলি। সল্টলেকের একটি শপিং সেন্টারে গত শুক্রবারই একসঙ্গে এমনই ৪২ জনকে কাজে যোগ দিতে বারণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের একটি শপিং মলের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার দীপ বিশ্বাস বললেন, “কিছুটা সমস্যা হচ্ছে ঠিকই। লকডাউনের মধ্যে তাই গাড়ি পাঠিয়ে অনেককে আনিয়ে নিয়েছিলাম আমরা।” কিন্তু বাকিরা? উত্তর দেননি দীপ।
পার্ক সার্কাসের একটি শপিং মলের কর্তা সঞ্জীব মেহরা বললেন, “খুবই দুঃখজনক ঘটনা। অবশ্য বাধ্য না হলে কেউই কাউকে আসতে বারণ করবেন না। মনে হয় তিন-চার মাসের মধ্যে পরিস্থিতি ঠিক হবে।”
সেক্টর ফাইভ স্টেক হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি কল্যাণ করের অবশ্য যুক্তি, “ওয়ার্ক ফ্রম হোমের চল বাড়তে থাকলে অফিসের নিরাপত্তারক্ষী, পার্কিং লটের কর্মী থেকে ক্যান্টিনের লোক— অনেকেরই প্রয়োজন কমবে। কোম্পানিগুলি স্বাভাবিক ভাবেই তখন দূরের লোকজনকে ছাঁটাই করবে। তবে মনে হয় আগামী বছরের শুরুতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।” শিয়ালদহের একটি পোশাক বিপণির কর্মী, ডানকুনি লোকালের নিত্যযাত্রী নিমাই দে-র প্রশ্ন, “তত দিন খাব কী?”
কবে লোকাল ট্রেন চলবে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চারটি কেন্দ্রীয় বিভাগকে (রেল, স্বাস্থ্য, নগরোন্নয়ন এবং স্কুলশিক্ষা সংক্রান্ত বিভাগ) এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর) তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছে। তবে ওই গণপরিবহণে প্রবল ভিড়ের জন্যই কিছুটা দ্বিধায় কেন্দ্র।
নিমাইবাবু বলছিলেন, “ট্রেনের বন্ধুরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়েছিল। সেখানে হামেশাই আমায় নিয়ে মশকরা করত। কিন্তু এখন আর তারা কেউ খোঁজ নেয় না। যেতে হবে না বলে দেওয়ার পরে অফিসও আর খোঁজ নেয়নি। ট্রেন চলা শুরু হলেও অফিসে হয়তো আর যাওয়া হবে না।”