ফাইল চিত্র।
কোলে বছর চারেকের ছেলে। এক হাতে ছাতা। পাশে স্ত্রীর কোলে মেয়ে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মহিলা ছাতা খোলারই ফুরসত পাননি। কারও মুখেই মাস্ক নেই। লাইন দিয়ে হাতিবাগান সর্বজনীনের ‘নো-এন্ট্রি’ বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছতেই বিরক্ত হয়ে কাঁদতে থাকা ছেলে বাবাকে বলল, “আর ঠাকুর দেখব না! খিদে পেয়েছে।” বাবার উত্তর, “চার জায়গা ঘুরে ঠাকুরের মুখ দেখেছ তো মাত্র একটা। এটা দেখেই সোজা হোটেলে ঢুকব!”
আদালতের নির্দেশে মণ্ডপে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও এ ভাবেই এক পুজোর ‘নো-এন্ট্রি’ থেকে আর এক পুজোর ‘নো-এন্ট্রি’ এলাকা এবং সব শেষে রেস্তরাঁর ভিড়ে লাইন দিয়েই সপ্তমী কাটল শহরের পুজো-জনতার। চলল মাস্ক নামিয়ে দেদার নিজস্বী তোলা এবং গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে দূর থেকে প্রতিমার ছবি মোবাইলে বন্দি করার চেষ্টা। বাগবাজারের মণ্ডপের সামনে মাস্কহীন দর্শনার্থীদের নিজস্বী তোলার হিড়িক দেখে হুইলচেয়ারে বসা এক বৃদ্ধা বললেন, “এঁদের ভয়েই বাড়ি থেকে ছেলেরা আনতে চাইছিল না। কিন্তু বাগবাজারের প্রতিমা দেখাটা ৫০ বছরের অভ্যাস। দূর থেকে দেখেই ফিরে যাব। কিন্তু এঁদের দেখলে কে বলবে, আদালত কড়া একটা নির্দেশ দিয়েছে!”
সুরুচি সঙ্ঘের মতো পুজোর উদ্যোক্তা স্বরূপ বিশ্বাস বললেন, “মণ্ডপে লোক কম। কিন্তু শহরের রেস্তরাঁগুলো ঘুরে দেখুন, কী অবস্থা! এ ভাবে চললে মণ্ডপ দর্শকশূন্য রাখার যে উদ্দেশ্য, তা সফল হবে তো?” টালা বারোয়ারির পুজোকর্তা অভিষেক ভট্টাচার্যের আবার দাবি, “বাসে-ট্রামে-রেস্তরাঁয় বা আমাদের মণ্ডপ পর্যন্ত আসার পথে যে ভিড় হচ্ছে, সেটা ১৪৪ ধারা বা লকডাউন জারি না করে বন্ধ করা যায় কখনও? আদালতের রায়কে অমান্য না করেই বলছি, এখন মনে হচ্ছে, জোর করে পুজো মণ্ডপ বন্ধ করা হল।”
এ দিনের ভিড় যে ষষ্ঠীকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, তা মানছেন একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজোর উদ্যোক্তারা। পুজোকর্তা সু্ব্রত মুখোপাধ্যায় বললেন, “বাইরে থেকেই প্রতিমা দেখা যাচ্ছে। শুধু মণ্ডপে ঢোকা হবে না। উৎসবের মধ্যে কেউ বাড়ি বসে থাকতে চান না। ওইটুকু অপ্রাপ্তি মেনেই লোকজন বেরিয়ে পড়ছেন।” সন্ধ্যায় দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর উদ্যোক্তা সুদীপ্ত কুমার আবার বললেন, “রায় নিয়ে কারও ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। মানুষ যেমন আসার, তেমনই আসছেন। এখান থেকে বেরিয়েই হয়তো কোনও রেস্তরাঁর বাইরে লাইন দেবেন সকলে। সেখানে করোনার বিপদ রোখা যাবে তো?”
আশঙ্কা যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়, তা মালুম হয় ম্যাডক্স স্কোয়ার সংলগ্ন একটি রেস্তরাঁর সামনের লাইন দেখে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে অনেকেই দূরত্ব-বিধি ভুলেছেন, খুলে ফেলেছেন মাস্কও। সেখানেই দাঁড়ানো তন্দ্রা সাহা বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা থামিয়ে বললেন, “ম্যাডক্সে বিনা পয়সায় বসে আড্ডা দেওয়া যেত। আদালতের নির্দেশে তা বন্ধ। কিন্তু শহরের কাফেগুলো আছে তো!” হিন্দুস্থান পার্কের প্রতিমা দেখার চেষ্টা করে বেরিয়ে একটি রেস্তরাঁর সামনে লাইন দেওয়া এক পরিবারের সদস্য সুবিমল কর্মকার বললেন, “পুজোয় কোনও বারই সে ভাবে ঠাকুর দেখি না। আসল হল, রেস্তরাঁয় খাওয়া, পার্টি আর আড্ডা। কোনওটাই এ বার নিষিদ্ধ নয়। চিন্তাও নেই।”
হাতিবাগানের একটি খাবারের দোকানের লাইন এ দিন রাত ৮টার পরে পৌঁছে গিয়েছিল বিধান সরণির ট্রামলাইন পর্যন্ত। সেই লাইনে দাঁড়ানো যুগলের দাবি, “পুজোয় লোকে নতুন কিছু করতে চায়। একঘেয়ে বাড়িতে কেউ বসে থাকে নাকি! সাত মাস তো করোনার সঙ্গেই কাটিয়ে দিলাম, পুজোর ভিড়ে আর কী হবে?”
‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর সাধারণ সম্পাদক তথা হাতিবাগান সর্বজনীনের পুজোকর্তা শাশ্বত বসু বললেন, “ভিড়ের অভিমুখ শুধু বদলে দেওয়া হয়েছে। মণ্ডপের বদলে রেস্তরাঁ! ভিড়ের বিপদ কি তাতে কাটবে?” শহরের এক রেস্তরাঁ চেনের আধিকারিক সৌরভ ঘোষ বললেন, “সাত মাস পরে মনের মতো ভিড় হচ্ছে এখানে। নিরাপত্তা-বিধি মেনেই সব হচ্ছে। পুজোর দাদারা রাগ করলে হবে!”