বাড়িতে ছেলে কোলে তপেন। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
আদরের নাম প্রিন্স। অস্ত্রোপচারের ১৮ ঘণ্টা পরে মা পিঙ্কি ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসককে চড় কষিয়ে বাবা তপেন ভট্টাচার্য থানা, আদালত ও হাসপাতালে চক্কর কাটছেন। ডাক্তার-নিগ্রহে অভিযুক্ত বাবার শাস্তি, নাকি খুদে প্রিন্সের আঙুল ধরে সহমর্মিতা জানানো— কোনটা বেশি জরুরি, সেই প্রশ্ন উঠল সোমবার।
চিকিৎসকদের একাংশ অবশ্য ডাক্তার-নিগ্রহে অভিযুক্তের শাস্তির দাবিতে অনড়। তবে ডাক্তারদেরই অন্য একটি অংশের বক্তব্য, মানবিক দৃষ্টিকোণ এড়িয়ে এ-রকম অবস্থান চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে কার্যত মেরুকরণেরই সমান। যা কোনও ভাবেই কাম্য হতে পারে না।
১৩ ফেব্রুয়ারি সিএমআরআই হাসপাতালে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন হাওড়ার বাসিন্দা পিঙ্কি। মা ও সন্তান দু’জনেই সুস্থ, এ কথা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলেন পিঙ্কির স্বামী। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরের দিন ভোর ৫টা নাগাদ পিঙ্কিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে চিকিৎসক বাসব মুখোপাধ্যায়কে চড়, থানায় অভিযোগ, তপেনের গ্রেফতারের দাবিতে বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের স্মারকলিপি— বিতর্কের জল গড়িয়েছে বহু দূর। পুলিশের তলব পেয়ে বাবা যখন আলিপুর থানার তদন্তকারীদের প্রশ্নের সম্মুখীন, তখন বেসরকারি হাসপাতালে ‘নিওনেটাল জন্ডিসে’ আক্রান্ত প্রিন্স।
আরও পড়ুন: বাবা-মা, স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় যাবজ্জীবন
সিএমআরআই সূত্রের খবর, এ দিন প্রিন্সের শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা ছিল পাঁচের কম। এ দিনই আলিপুর সিজেএম আদালতে আত্মসমর্পণের পরে কুড়ি হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে অন্তর্বর্তী জামিন পান তপেন। সন্ধ্যায় প্রিন্সকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। জামিন পেয়েছেন অভিযুক্তের তালিকায় থাকা, তপেনের আত্মীয়া দেবশ্রী ভট্টাচার্যও। পরবর্তী শুনানি ১৫ মে। তপেন বলেন, ‘‘কোন মানসিক পরিস্থিতিতে চিকিৎসককে চড় মারলাম, তা বিচার করলে ভাল হয়।’’
এক প্রবীণ ক্যানসার চিকিৎসকের যুক্তি, ‘‘অপরাধীরও পরিবার থাকে। তা বলে কি আইন আইনের পথে চলবে না!’’ স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই পরিবারের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। কিন্তু কোনও সভ্য দেশে চিকিৎসক পিটিয়ে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে, তা হতে পারে না। ডাক্তার পিটিয়ে সকলেই তো তা হলে বলবে, আমার মানসিক অবস্থা ঠিক ছিল না!’’
তবে বেসরকারি হাসপাতালের কার্ডিয়োথোরাসিক বিভাগের চিকিৎসক কুণাল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অন্য রকম। এ দিন তিনি জানান, গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র এগোতে পারে না। মানবিকতার খাতিরে রোগী এবং চিকিৎসক দু’পক্ষকে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে এই মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে হবে। ‘‘আচরণ সংশোধনে এগিতে আসতে হবে রোগীর আত্মীয়দের। আবার অস্ত্রোপচারের এত পরে কেন রোগিণী মারা গেলেন, সেটারও চিকিৎসাশাস্ত্র-সম্মত ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রসূতির মৃত্যু যেন ডাক্তারির শাহিন বাগ হয়ে না-যায়,’’ বললেন কুণালবাবু।