সমস্যা হচ্ছে মুখ্যসচিবের মোবাইলে। তাই আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হল প্রেসিডেন্সি জেলের একটি জ্যামার। এর আগে আলিপুর জেলের জ্যামার তাঁর মোবাইলে সমস্যা করছিল বলে সন্দেহ করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। নড়েচড়ে বসেছিল রাজ্য প্রশাসন থেকে কারা দফতর। জ্যামার বসানোর কাজ বন্ধের নির্দেশও দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আলিপুর জেলের ওই জ্যামার বন্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি।
কেন সমস্যা হয় আলিপুর জেলের ওই জ্যামার নিয়ে?
৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে নিজের বাড়িতে ঢুকলেই হল। ফোনে কথা বলতে গেলেই মাঝপথে কেটে যাচ্ছে। সে আই-ফোনই হোক বা হালের স্মার্টফোন। ফোনের জন্য প্রতিদিন এ ভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মুড অফ’ হতে দেখে হয়রান হচ্ছিলেন তাঁর দলের নেতা এবং প্রশাসনের কর্তারাও। বারবার এ ভাবে ‘কল ড্রপ’ হতে থাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ধারণা হয়, নিশ্চয়ই ফোন ট্যাপ হচ্ছে। তা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহলে আলোড়ন পড়ে যায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর সন্দেহ হয়— পাশেই আলিপুর জেলে যে জ্যামার বসানো হচ্ছে, তাতেই ‘জ্যাম হয়ে যাচ্ছে তাঁর যাবতীয় ফোন। আর সে জন্যই জরুরি কথা বলার ফাঁকেই ‘কট’ করে কেটে যাচ্ছে কল-টা।
মুখ্যমন্ত্রীর সন্দেহের কথা জানার পরে রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি জানান কারা দফতরের সচিব শিবাজী ঘোষকে। নতুন কারা দফতরের দায়িত্ব পাওয়া শিবাজীবাবুর তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। তাই কোনও কিছু না ভেবেই তড়িঘড়ি তিনি নির্দেশ দিয়ে দেন, অবিলম্বে আলিপুর জেলে জ্যামার বসানোর কাজই বন্ধ করে দেওয়া হোক।
সচিব নির্দেশ দিলেও বিষয়টি একেবারেই পছন্দ হয়নি কারা দফতরের অন্য কর্তাদের। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, জ্যামার আসলে ভিলেন-ই নয়, এর পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে। শেষমেশ মাসখানেক কাজ বন্ধ রাখার পরে মেশিন-পত্তর এনে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে পরীক্ষা করে দেখা গেল, সত্যিই তাঁর সন্দেহ অমূলক। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বসানো জ্যামারে মোটেই মুখ্যমন্ত্রীর মোবাইলের নেটওয়ার্ক ‘জ্যাম’ হচ্ছে না। এই রিপোর্ট পেয়ে অবশেষে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন কারা-কর্তারা। ফের শুরু হয়েছে জ্যামার বসানোর কাজও।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে ‘জ্যামার’ থাবা বসাতে না পারলেও মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের বাড়িতে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়ায় সমস্যা তৈরি করছে জ্যামার। সে কারণে আপাতত প্রেসিডেন্সি জেলের একটি জ্যামার বন্ধ রাখা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের পাশের খাল পেরোলেই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের পাঁচিল। সেখানে মাস তিনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে জ্যামার বসানোর কাজ। মোট ১০টি জ্যামার বসানো হচ্ছে। এর মধ্যে সাতটি ইতিমধ্যেই বসানো হয়েছে জেলের ছাদে। বাকি তিনটি বসানো হবে মাটি খুঁড়ে। কাজ শুরু হওয়ার পরে প্রথমে বসানো শুরু হয় ছাদের জ্যামারগুলি। এর পরপরই বাড়িতে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী মোবাইলে কথা বলতে গেলেই বারবার ফোন কেটে যেতে থাকে। প্রথমে ফোন ‘ট্যাপ’ হচ্ছে ভাবলেও পরে মুখ্যমন্ত্রীর সব রাগ গিয়ে পড়ে জ্যামারের উপরেই। খবর দেন রাজ্যের মুখ্যসচিব, ডিজি, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কারা দফতরের সচিব শিবাজী ঘোষকে। মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন অভিযোগ পাওয়ার পরে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ যায় এখুনি জেলের জ্যামার বসানোর কাজ বন্ধ করে দেওয়া হোক।
ফাঁপড়ে পড়েন কারাকর্তারা। এক কর্তার কথায়, ‘‘বারবার জেলে মোবাইল উদ্ধার হওয়ার জেরে জ্যামার বসানোর উপরে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীই। এমনকী, তাঁরই দলের এক নেতা গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়ার পরে সেখান থেকে সরাসরি ফোন করে বসেন মুখ্যমন্ত্রীকে। এর পরেই তিনি যে ভাবে হোক জেলের মধ্যে মোবাইল বন্ধের নির্দেশ দেন। সে জন্যই সাড়ে আট কোটির বেশি টাকা খরচ করে জ্যামার বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন সেই তিনিই জ্যামার বসানো বন্ধ করতে বলায় একটু তো মুশকিলে পড়তে হয়েছিলই।’’
শেষমেশ উপায় বাতলান জ্যামার বসাতে আসা সংস্থার ইঞ্জিনিয়ারেরা। তাঁরা জানান, মেশিন দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া যাবে, জ্যামারের শব্দতরঙ্গ কোনও ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছচ্ছে না। সেইমতো ওই ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে নিয়ে গত ১ জুন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যান পুলিশ ও কারা দফতরের পদস্থ কর্তারা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির চৌহদ্দি। নিঃসন্দেহ হওয়ার পরে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন কারা-কর্তারা। এর পরেই ফের জোরকদমে শুরু করে দেওয়া হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে জ্যামার বসানোর কাজ।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে তেমন কোনও প্রমাণ না মিললেও মুখ্যসচিবের বাড়িতে জ্যামারের জন্য নেটওয়ার্ক না-পাওয়ার অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। সে কারণে প্রেসিডেন্সি জেলে যে দশটি জ্যামার বসানো হয়েছিল, তার মধ্যে একটি জ্যামার বন্ধ রাখা হয়েছে।
প্রেসিডেন্সি ছাড়া কলকাতার দমদম সেন্ট্রাল জেলেও জ্যামার বসানোর কাজ শুরু করেছে কারা দফতর। দমদম জেলের এলাকা বড় বলে এখানে ১৩টি জ্যামার বসানো হচ্ছে। আগামী দু’এক মাসের মধ্যেই কলকাতার এই তিন জেলে জ্যামার বসানোর কাজ হয়ে যাবে বলে কারা দফতর সূত্রের খবর।