পুরোদমে: চলছে ফানুস তৈরির কাজ। শনিবার, বিডন স্ট্রিটে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
শব্দ নেই, নেই মারাত্মক ধোঁয়াও। কিন্তু কালীপুজোর আকাশ মানেই সাঁঝের আকাশে ভেসে বেড়ানো একের পর এক বাতি!
কখনও বা ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে গোধূলির আলোয় ধরা পড়ে পেল্লায় ফুটবল কিংবা দাবার রাজা-উজিরের চেহারা! দূষণ ছড়ানো শব্দবাজি বা আতসবাজির রমরমা হওয়ার অনেক আগে থেকে এমন সব ফানুসেরই রমরমা ছিল কলকাতায়। সংখ্যা কমলেও এই শহরের কিছু মানুষ এখনও বুকে আগলে রেখেছেন এই পুরনো ঐতিহ্য এবং তাঁরা জানাচ্ছেন, নতুন প্রজন্মের হাতেগোনা কিছু মুখও এই রেওয়াজকে ভালবেসেছে। বাজি নিয়ে কড়াক়়ড়ির সময়ে বিডন স্ট্রিটের অজয় দত্ত, ভদ্রেশ্বরের শচীন মুখোপাধ্যায়েরা রব তুলছেন, বাঙালি বাজি ভুলে আরও মেতে উঠুক এই সাঁঝবাতিতেই।
১৯২৫ সাল থেকে বিডন স্ট্রিটের দত্ত বাড়িতে কালীপুজোর দিন ফানুস ওড়ানোর রেওয়াজ শুরু হয়েছে। বছরের হিসেবে এ বার ৯৩-এ পা দিল দত্ত বাড়ির ফানুস-উৎসব। এ বছর ১৫০ ইঞ্চি বা তার থেকেও বড় ফানুস ওড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বিডন স্ট্রিটের দত্তবাড়ি। গৃহকর্তা অজয় দত্ত বলছেন, ‘‘ইদানীং সরাসরি বাজার থেকে কেনা ফানুসের রমরমা বাড়লেও আমরা নিজেরাই ফানুস তৈরি করি। এর উদ্দেশ্য শুধু ফানুস ওড়ানো নয়, ফানুস তৈরির পরম্পরাকেও বাঁচিয়ে রাখা।’’ প্রবীণ অজয়বাবু জানালেন, বিডন স্ট্রিটের আগে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা থাকতেন শোভাবাজারে। সেখানেও কালীপুজোর সময়ে ফানুস ওড়ানো হত। তবে অজয়বাবুর আক্ষেপ, ‘‘কালের নিয়মে দত্ত বাড়িতেও এখন ফানুস তৈরির লোকবলের বেশ অভাব। বাড়ির তরুণ প্রজন্মের বেশির ভাগই নিজেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত।’’ কিন্তু তাতেও পরোয়া নেই। দীপঙ্কর দাস ও অভিষেক দত্তের মতো সহকারীদের নিয়ে বিডন স্ট্রিটের বাড়িতেই ফানুস তৈরির নানা কায়দা শেখাচ্ছেন তিনি। সেই শিক্ষায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন আরও অনেকে।
ভদ্রেশ্বরের বাসিন্দা দীর্ঘদিনের ফানুসপ্রেমী প্রবীণ মানুষ শচীন মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘নানা কাজের মাঝেই ঘরের কোণে কিছুক্ষণ ফানুসের কাগজ, কাঠি, আঠা নিয়ে কাটালে মন্দ কী!’’ তাঁর মতে, নিজের সৃষ্টি যখন আকাশে উড়বে, তখন তার আনন্দ অনেক বেশি। সেই আনন্দেই এখনও মজে রয়েছেন সত্তর পেরোনো এই মানুষটি। এই কলকাতায় বেশ কিছু ছাত্রও রয়েছে তাঁর।
প্রবীণ ফানুসপ্রেমীরা জানাচ্ছেন, ইদানীং ফানুসে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে। যেমন তাঁদেরই এক জন পেশায় মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রজতকুমার মল্লিক। জনা ছয়েক বন্ধু মিলে একটি ফানুস ওড়ানোর দলও তৈরি করে ফেলেছেন। তৈরি করে ফেলছেন নানা নকশার বাহারি ফানুস। প্রথম দিকে শিক্ষার শুরু ইন্টারনেট দেখে। পরে পরামর্শ নেন কয়েক জন প্রবীণ ফানুসপ্রেমীর। পুজো, উৎসবের পাশাপাশি বিশেষ কিছু দিনেও ফানুস ওড়ানোর জন্য তাঁদের এখন ডাক পড়ে বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠনের পক্ষ থেকে। এ বছরও কালীপুজোয় রজতবাবুদের হাতে তৈরি বেশ কিছু ফানুস কলকাতার আকাশে উড়বে। তাঁদের মতো ফানুস অনুরাগীদের আশা, নতুন প্রজন্মের এই উৎসাহের হাত ধরেই আকাশে ভেসে থাকবে সাঁঝবাতিরা!