অস্ত্রোপচারের পরে বাড়িতে জাকির হোসেন। নিজস্ব চিত্র
ছোট্ট ক্যাম্পেই কোনও মতে শুয়ে দিন কাটত। বন্ধু-পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় ছিল না। মুখের ঘা-এর কারণে যন্ত্রণা হলেও হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। কলকাতা থেকে পরিজনেরা ফোন করলে শুধুই চোখের জল ফেলতেন বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়!
দাঁত তোলার পরে মুখে ঘা হওয়ায় পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেনের ঠাঁই হয় ইরাকের একটি কোয়রান্টিন কেন্দ্রে। সেখানকার কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার অনুরোধ করেও জানতে পারছিলেন না, আসলে কী রোগ হয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছিল, মুখের ঘা-ও তত ছড়াচ্ছিল। জাকির বাড়ি ফিরতে চাইলেও তাতে আমল দিচ্ছিলেন না, তিনি যে সংস্থায় কর্মরত সেখানকার কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হতে শুরু করে। প্রায় এক মাস পরে এক দিন আচমকা ওই সংস্থা জানায়, চাকরিতে ইস্তফা দিলে তবেই মিলবে ফেরার অনুমতি। প্রাণ বাঁচাতে তাতেই রাজি হয়ে যান পার্ক সার্কাসের ওই বাসিন্দা।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি জাকির ফেরেন কলকাতায়। ক্যানসার চিকিৎসক সোমনাথ সরকারের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত, যা তত দিনে চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না করালে বিপদ হতে পারে। পিয়ারলেস হাসপাতালে জাকিরের অস্ত্রোপচার করেন ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘চোয়ালের অনেকটা অংশে ক্যানসার ছড়িয়ে গিয়েছিল। ইরাকে পরীক্ষা করানো হলেও সেই সম্পর্কে রোগীকে কিছুই জানানো হয়নি। উল্টে একটা অনিশ্চিত জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছিল।’’
জাকিরের পরিজনেরা জানাচ্ছেন, সৌদি আরবের এক সংস্থায় দীর্ঘ দিন চাকরি করেছেন তিনি। মাঝে বছরখানেক কলকাতায় ছিলেন। গত এপ্রিলে তাঁকে ইরাকে বদলি করা হয়। এর মাসখানেক পরে দাঁতে সমস্যা শুরু হয় জাকিরের। যে সংস্থায় চাকরি করতেন, তাদের মাধ্যমেই এক দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসক দাঁত তুললেও মাড়িতে ঘা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকায় চিকিৎসক বায়প্সি করান। কিন্তু রিপোর্ট চলে যায় সংস্থার হাতে। তাতে কী আছে, জাকিরকে না জানিয়েই পাঠানো হয় কোয়রান্টিন কেন্দ্রে।
ওই প্রৌঢ়ের আত্মীয় শাকিল আহমেদ জানান, কোয়রান্টিন কেন্দ্রে চিকিৎসক ছিলেন না। তবে রোজ জাকিরকে ওষুধ খাওয়ানো হত। কিন্তু কিসের ওষুধ বলা হত না। শাকিলের দাবি, ‘‘বায়প্সি রিপোর্ট বা রোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলা হত, তিনি সুস্থ রয়েছেন। তেমন কিছু হয়নি। ক্যানসারের কথাটা চেপে গিয়েছিলেন ওঁরা।’’ শেষে চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয় জাকিরকে। তাঁর প্রাপ্য থেকে ভারতীয় মুদ্রায় দু’লক্ষেরও বেশি টাকা কেটে নেওয়া হয়।
সম্প্রতি প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে জাকিরের অস্ত্রোপচার করেন গৌতমবাবুরা। তিনি জানাচ্ছেন, দাঁতের গোড়া থেকে ক্যানসার ছড়িয়ে গিয়েছিল চোয়ালে। অস্ত্রোপচারে চোয়ালের অর্ধেকেরও বেশি অংশ এবং গলার কিছু গ্রন্থি কেটে বাদ দিতে হয়। তার পরে পা থেকে হাড় নিয়ে পুনরায় চোয়াল তৈরি করেন প্লাস্টিক সার্জারির চিকিৎসক। গৌতমবাবুর সঙ্গে অস্ত্রোপচারের দলে ছিলেন প্লাস্টিক সার্জারির চিকিৎসক অনুপম গোলাস, অ্যানাস্থেশিয়ার চিকিৎসক জনমেজয় সেনগুপ্ত।
আফগানিস্তান থেকে ইরাকের দূরত্ব দু’হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। বাড়ি ফিরে টিভিতে এখন সেখানকার খবর দেখছেন জাকির। পুরনো দিনের কথা আর মনে করতে চান না তিনি। তবে আকারে-ইঙ্গিতে জানাচ্ছেন, ঘর ছেড়ে আর অন্য মুলুকে নয়!