প্রতীকী ছবি
একা ডায়াবিটিস নয়, দোসর করোনা। তার উপরে ‘গুলেন বারি সিন্ড্রোম’। যাকে বলে ত্র্যহস্পর্শ! তিন ব্যাধির চক্রব্যূহ ভেদ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধ। করোনা-কালে চিকিৎসকেরা ডায়াবিটিসের মতো নিঃশব্দ ঘাতক রোগে আক্রান্তদের বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে বলেন। তিন রোগকে হারিয়ে বৃদ্ধ যে-ভাবে হেঁটে বাড়ি ফিরলেন, তাতে চিকিৎসকেরাও চমৎকৃত।
চিকিৎসকদের মতে, ‘গুলেন বারি সিন্ড্রোম’ হল এক ধরনের ভাইরাল সংক্রমণ, যার আক্রমণে স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যায়। সংক্রমণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রোগীর দ্রুত অবনতির আশঙ্কা থাকে। কার্যত পক্ষাঘাতের শিকার হয় সারা শরীর। বছর দুয়েক আগে প্রথম বার জিবি সিন্ড্রোমের আক্রমণে উত্তর কলকাতার ওই বৃদ্ধের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল। এ বছর জুনে দ্বিতীয় বারের সংক্রমণে তাঁর হাত-পায়ের সক্রিয়তা নষ্ট হয়ে যায়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। যেটা করোনারও অন্যতম উপসর্গ। দুই ‘বহিরাগত’ যে বৃদ্ধের শরীরে হানা দিয়েছে, প্রথমে তা বোঝা যায়নি। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পরের দিন পরীক্ষায় ধরা পড়ে করোনা।
বৃদ্ধের ছেলে জানান, ৮ জুন বাবা দাঁড়াতে পারছেন না দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। দু’বছর আগে খুব কাছ থেকে গুলেন বারি সিন্ড্রোমকে দেখেছিলেন বলে উপসর্গ চিনতে ভুল করেননি ছেলে। প্রথম বারের মতো এ বারেও মল্লিকবাজারে স্নায়ুরোগের বেসরকারি হাসপাতালে বাবাকে নিয়ে যান তিনি। সেখানে নিউরোলজিস্ট হৃষীকেশ কুমারের নেতৃত্বে বৃদ্ধকে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসক নীলাঞ্চল চক্রবর্তী এবং সংযুক্তা শ্যাম রাইয়ের তত্ত্বাবধানে ভেন্টিলেশনে রাখা হয় তাঁকে। সেই থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত ভেন্টিলেশনেই ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: শিবির করে ফ্ল্যাট, বাড়ির সমস্যা শুনবে পুরসভা
‘‘বাবার দেহে অক্সিজেনের মাত্রা কমে ৭০-৭৫ হয়ে গিয়েছিল। ভেন্টিলেটরের সাহায্যে কোনও মতে তা নব্বইয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। একে গুলেন বারি, তার উপরে করোনা। এক সময়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম,’’ বললেন ছেলে। জুনের শেষ দিকে চমক দিয়ে আচমকা ঘুরে দাঁড়ান বৃদ্ধ। দেহে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকায় ভেন্টিলেটর থেকে বার করা হয় তাঁকে।
ভেন্টিলেটর পর্ব ভাইরাস-যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বৃদ্ধকে শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পেতে সাহায্য করেন হাসপাতালের নিউরো রিহ্যাবিলিটেশনের ডিরেক্টর-চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর সহযোগীরা। ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসকে চাঙ্গা করতে শুরু হয় চেস্ট ফিজিয়োথেরাপি। জমা কফ সেই প্রক্রিয়ায় বার করার পরে মাংসপেশির অনুভূতি ফেরানোর উপরে জোর দেয় রিহ্যাব টিম। চিকিৎসকের পরিভাষায় যার নাম ‘মোটর রিলার্নিং থেরাপি’। প্রায় এক মাস স্নায়ুরোগের হাসপাতালে থাকার পরে ২ জুলাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন বৃদ্ধ।
বৃদ্ধের শরীরে দ্বিতীয় বার জিবি সিন্ড্রোমের হানার জন্য কি কোভিডকে কাঠগড়ায় তোলা যায়? ‘‘সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, আবার নিশ্চিত করেও বলা সম্ভব নয়। তবে কো-মর্বিডিটির শিকার এক জন বয়স্ক মানুষ যে-ভাবে কোভিড ও গুলেন বারি সিন্ড্রোমকে পর্যুদস্ত করলেন, তা অভূতপূর্ব,’’ বলেন সুপর্ণবাবু।
হাসপাতালের আইটিইউয়ের চিকিৎসক নীলাঞ্চলবাবু জানান, বৃদ্ধের পায়ের মাংসপেশির পাশাপাশি শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত মাংসপেশিও নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। কোভিডের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল নিউমোনিয়া। রক্তে কমছিল শ্বেতকণিকার সংখ্যা। রক্ততঞ্চন প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছিল। চিকিৎসকের কথায়, ‘‘গুলেন বারি সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে ইমিউনোগ্লোবিউলিন ব্যবহার করি আমরা। ইদানীং কোভিড নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যবহৃত হচ্ছে। বৃদ্ধকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দিয়ে কাজ হয় কি না, তা দেখা হয়। ভেন্টিলেশনে থাকার দু’সপ্তাহ পরে রোগীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। অতি সঙ্কটজনক অবস্থা থেকে উনি যখন হেঁটে বাড়ি ফিরছেন, সেটাই সব চেয়ে আনন্দের মুহূর্ত।’’