অগ্রণী: বাড়ির সামনে রতন দাস। (ইনসেটে) মালা রায়। নিজস্ব চিত্র
‘শরীর কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না! শরীর আদতে সমাজের সম্পত্তি। তাই সমাজের উন্নতির জন্যই চিকিৎসা গবেষণার কাজে মৃত্যুর পরে শরীর দিয়ে যাব।’— সাদা কাগজে মোটা হরফে লেখা কথাগুলো পড়ে অশীতিপর বৃদ্ধ বললেন, ‘‘চৌত্রিশ বছর আগে এই কথার জোরেই মরণোত্তর দেহদানে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম পাঁচ জন। গত বুধবার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, দূরত্ব-বিধি মানার এই আবহে মরণোত্তর দেহ নেওয়ার জায়গাতেই আর নেই এ সমাজ। চিকিৎসকেরা স্পষ্ট জানালেন, ছাত্রেরা তো সব অনলাইনে পড়শোনা করছে। দানের দেহ নিয়ে কী হবে!’’
বৃদ্ধের নাম রতন দাস। ১৯৮৬ সালের ৫ নভেম্বর এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে এ রাজ্যে প্রথম যে পাঁচ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি তাঁদেরই এক জন। তাঁর স্ত্রী, বছর আটাত্তরের মালা রায়ও ছিলেন ওই পাঁচ জনের মধ্যে। গত বুধবারই নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে মালাদেবীর দান করে যাওয়া দেহ আর ওই হাসপাতাল নিতে চায়নি বলে বৃদ্ধের দাবি।
ভবানীপুর দেবেন্দ্র ঘোষ রোডের দু’কামরার ছোট্ট ঘরে বসে রতনবাবু জানান, ছ’বছর বয়স থেকেই দৃষ্টিহীন মালা। বুঝতেন অঙ্গদানের গুরুত্ব। তাই তাঁর দাদা ব্রজ রায়ের অঙ্গ ও দেহদান সচেতনতার কর্মসূচিতে আগাগোড়া থাকতেন তিনি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই শ্লেষ্মার সমস্যায় ভুগছিলেন মালাদেবী। মঙ্গলবার থেকে তাঁর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। রতনবাবু বলেন, ‘‘বুধবার অবস্থা আরও খারাপ হয়। একে করোনা পরিস্থিতি, তার মধ্যে ওই দিন ছিল লকডাউন। কোনও অ্যাম্বুল্যান্সের চালক প্রচুর টাকা চাইছেন, তো কেউ করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে বলছেন। শ্লেষ্মার রোগীর করোনা রিপোর্ট কোথায় পাব? শেষে মালার ভাইপো গাড়ি নিয়ে এসে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, পথেই ওর মৃত্যু হয়েছে।’’
বৃদ্ধ এর পর বলেন, ‘‘পথেই মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল ময়না-তদন্ত করল। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনুরোধ করলাম, মালা মরণোত্তর দেহদানে রাজ্যের প্রথম পাঁচ জনের এক জন। যদি তাঁদের কোনও কাজে লাগে। তখনই চিকিৎসকেরা বলে দিলেন, ডাক্তারি পড়ুয়াই নেই, মরণোত্তর দেহ নিয়ে আর কী হবে! অনলাইন পড়াশোনায় তো আর মরদেহ কাটা যায় না!’’
কথা বলতে বলতে গলা কেঁপে যায় বৃদ্ধের। খানিক সামলে নিয়ে ফিরে যান তাঁদের দাম্পত্যের পুরনো কথায়। ১৯৭৮ সালের তাঁদের বিয়ের সময়ে। বলেন, ‘‘ব্রজ রায় আমার বন্ধু। এক দিন তিনি দৃষ্টিহীন বোনের বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাদের কাছে তখন সামাজিক কর্তব্য ছিল সকলের আগে। মনে হয়েছিল, দৃষ্টিহীন কাউকে সক্ষম কারও সঙ্গে সামাজিক ভাবে সমান আসনে বসানো তো কর্তব্য। সেই সামাজিক কর্তব্য থেকেই মালাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।” তিনি জানান, তাঁদের একটি সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসার গাফিলতিতে ১০ দিনের বেশি সে বাঁচেনি। সন্তান না থাকা নিয়ে অবশ্য বিশেষ আক্ষেপ ছিল না দম্পতির। ফিজিয়োথেরাপি করিয়ে আর মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান সচেতনতার প্রচার করে সময়টা কেটে গিয়েছিল তাঁদের।
একটু থেমে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। জীবিত মানুষের মধ্যেই যেখানে দূরত্ব বাড়িয়ে নেওয়া এখন মূল কথা, সেখানে যতই বিজ্ঞানের স্বার্থে দান করা হোক, মৃতদেহের থেকেও যে দূরত্ব বাড়বে— এ আর আশ্চর্য কী?’’ রাজ্যের দেহদান আন্দোলনের অন্যতম কর্মী তথা মালাদেবীর দাদা ব্রজবাবু বলেন, ‘‘আমার একটাই প্রশ্ন, বিজ্ঞান-গবেষণার স্বার্থ ভুলে আবার পিছনের দিকে হাঁটছি না তো?’’