বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি রুমে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য। —নিজস্ব চিত্র।
বেশ কয়েক দিনের টানাপড়েনের পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি কলা বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা ফিরিয়ে আনারই সিদ্ধান্ত নিল। মঙ্গলবার দীর্ঘ বৈঠকে ঠিক হয়েছে, খারিজ করা হচ্ছে ৪ জুলাই নেওয়া প্রবেশিকা পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত। প্রবেশিকা এবং দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তির যে-প্রস্তাব ২৭ জুন নেওয়া হয়েছিল, সেটাই বলবৎ হচ্ছে।
কিন্তু বড় খিঁচ থেকে যাচ্ছে এই সিদ্ধান্তেও। কেননা উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এবং সহ-উপাচার্য প্রদীপকুমার ঘোষ জানিয়ে দিয়েছেন, ভর্তি-পরীক্ষা ফেরানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাঁরা সহমত নন। শুধু জানিয়ে দেওয়াই নয়, সরে দাঁড়াতে চেয়েছেন দু’জনেই।
রাতে উপাচার্য সুরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘আমি এবং সহ-উপাচার্য কর্মসমিতির প্রবেশিকা ফেরানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি না। কারণ, রাজ্যপালের চিঠির প্রেক্ষিতে আইনজীবী যা বলেছেন, তার বাইরে আমরা যেতে পারব না। আমরা রাজ্যপালকে জানাব, এখানে সুস্থ প্রশাসন চালানো যায় না। প্রতিবাদের অর্থ কি সুস্থ সংস্কৃতির চিহ্ন থাকবে না? ‘উপাচার্যের চামড়া, তুলে নেব আমরা’— এমন ভাষার প্রয়োগ চলবে? এই অবস্থায় আমরা দু’জনেই অব্যাহতি চাইব।’’
কর্মসমিতির সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরেই নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসেন পড়ুয়ারা। অনশন তুলে নেওয়া হয় রাত সওয়া ১০টায়। কিন্তু পড়ুয়ারা জানান, আন্দোলন চলবে। কেননা স্বাধিকার যে খর্ব হচ্ছে না, সেই বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেননি। অনশন ওঠার মিনিট দশেক পরে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যান।
বিতর্ক শুরু হয়েছিল কলা বিভাগের ছ’টি বিষয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে। ২৭ জুন কর্মসমিতির জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রবেশিকা হবে। তবে শুধুই প্রবেশিকার ভিত্তিতে পড়ুয়া ভর্তি নেওয়া হবে না। ভর্তি হবে প্রবেশিকা এবং দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে। ভর্তি-পরীক্ষা থেকে নেওয়া হবে মোট ৫০% নম্বর। বাকি ৫০% উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় পড়ুয়ার প্রাপ্ত নম্বর থেকে যোগ হবে। কিন্তু ৪ জুলাই কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, কলা বিভাগের ছ’টি বিষয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে না। সেই সিদ্ধান্ত ঘিরেই শুরু হয় গোলমাল। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে উপাচার্যকে ঘেরাও করেন পড়ুয়ারা। দু’দিন পরে তিনি ঘেরাওমুক্ত হলেও সমস্যা মেটেনি।
শুক্রবার রাতে অনশন শুরু করেন ছাত্রছাত্রীদের একাংশ। বাংলা, ইংরেজি-সহ বিভিন্ন বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাই ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেন। সমস্যার সমাধানে আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে যান উপাচার্য। রিপোর্টও দেন। আচার্য পরে জানিয়ে দেন, বিধি মেনে এই ধরনের পরিস্থিতিতে পদক্ষেপ করার ক্ষমতা আছে উপাচার্যের হাতেই। তার পরেই এ দিন কর্মসমিতির বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়। কার্যত বৈঠক হয় দু’দফায়। প্রথম বৈঠকের শুরুতেই আচার্য-রাজ্যপালের পর্যবেক্ষণের বিবরণ দেন। তার পরেই জানিয়ে দেন, এ দিন আর কোনও আলোচনা হবে না। বেশ কিছু সদস্য বলতে থাকেন, কেন, প্রবেশিকা নিয়ে কথা হোক। কথা কাটাকাটি শুরু হয়। কিছু সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিউট বা বিধির উল্লেখ করে জানান, বৈঠকে একাধিক বিষয়ে আলোচনার সংস্থান আছে। তার পরে দ্বিতীয় দফায় আলোচনা হয় প্রবেশিকা নিয়েই।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ৪ জুলাই কর্মসমিতির ন’জন সদস্য প্রবেশিকা পরীক্ষার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। এ দিনের বৈঠকে ১২ জন প্রবেশিকার পক্ষে মত দিয়েছেন।
বৈঠকের ফলাফল: ১) কলা বিভাগের ছ’টি বিষয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে প্রবেশিকা পরীক্ষা থেকে নেওয়া হবে মোট ৫০% নম্বর। উচ্চ মাধ্যমিক অথবা সমতুল পরীক্ষায় পড়ুয়ার প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৫০ শতাংশ যোগ হবে। ২) ভর্তির প্রক্রিয়া ঠিক করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এবং কলা বিভাগের ডিন। ৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি কর্মসমিতি সম্পূর্ণ আস্থা দেখিয়েছে এবং গোটা ভর্তি প্রক্রিয়ায় তাঁদের সাহায্য চেয়েছে।
উপাচার্য সুরঞ্জনবাবু এবং সহ-উপাচার্য প্রদীপবাবু এই সিদ্ধান্তের অংশীদার হতে চাননি। সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন উচ্চশিক্ষা সংসদের প্রতিনিধি মনোজিৎ মণ্ডল। রেজিস্ট্রার চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য এ দিনের আলোচনায় যোগই দিতে চাননি। এই অবস্থায় উপাচার্য অব্যাহতির কথা বলায় ‘হোক কলরব’ মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকেরই। সেই আন্দোলনের জেরে পদত্যাগ করেন যাদবপুরের তখনকার উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সে-কথা ঘোষণা করেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুরঞ্জনবাবু অব্যাহতির ইচ্ছা প্রকাশ করায় শিক্ষক সংগঠন জুটা-র নেতা কেশব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অতীতে অনেক উপাচার্য কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তা-ই বলে অব্যাহতি নিতে হবে! এটা কোনও কথা নয়।’’ আর আন্দোলনকারী পড়ুয়া দেবরাজ দেবনাথ বলেন, ‘‘আমরা উপাচার্যের পদত্যাগ চাইনি। আমরা স্বাধিকারের লড়াই লড়েছি।’’
যোগাযোগের চেষ্টা করেও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পাওয়া যায়নি। তিনি অবশ্য আগেই বলেছিলেন, এখানে স্বাধিকারের প্রশ্ন জড়িত। তাই তিনি কিছু বলবেন না। তবে তৃণমূলের অন্দরের খবর, ‘ইচ্ছা পূরণ’ না-হওয়ায় খুশি নন নেতারা। বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতিতে তাঁদের ‘প্রতিনিধি’ মনোজিৎ মণ্ডল প্রবেশিকা ফেরানোর প্রশ্নে এ দিন নিজের আপত্তি নথিভুক্ত করিয়েছেন।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কথাতেও অনেকটা যেন শাসক দলেরই সুর। তিনি বলেন, ‘‘যাদবপুরে অন্য বিভাগগুলিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা হয় না। আসলে কলা বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা লাল, ফিকে লাল, অতি লালদের ক্যাডার তৈরির ফিকির। আর উপাচার্য অব্যাহতি চাইলে তো হবে না। এ তো ওঁর পালিয়ে যাওয়া।’’
ছাত্রছাত্রীদের অভিনন্দন জানিয়ে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী জানান, যাদবপুরে শেষ পর্যন্ত যুক্তির কাছে হার মেনেছে জেদ। শিক্ষা ক্ষেত্রে তৃণমূলের একাধিপত্য তৈরির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।