অসহায়: এনআরএসের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে থেকে ফিরে যাচ্ছেন অমিয়া দাস। শুক্রবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
নিউরো সার্জন নেই। তাই টিকিট হবে না। ইমার্জেন্সি কাউন্টারের কর্মী এ কথা জানিয়ে বিদায় করলেন রোগীর পরিজনকে।
নিউরো সার্জন নেই কেন? শুক্রবার কেউ থাকেন না? উত্তর মিলল না। বরং জুটল কিছুটা তাচ্ছিল্য। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে সোনারপুর কামরাবাঁধের অমিয়া দাসের পরিজনেরা জানালেন, এর আগে আরও দু’টি হাসপাতাল থেকেও তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরেই উঠে এসেছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী প্রত্যাখ্যানের ঘটনা। এই সব জায়গার মতোই এনআরএস-ও যে রোগী প্রত্যাখ্যানের ‘সংক্রমণ’ থেকে মুক্ত নয়, শুক্রবার হাসপাতাল চত্বর ঘুরে তারই সাক্ষী থাকল আনন্দবাজার।
ঘড়িতে তখন দুপুর ২টো বেজে ১৫ মিনিট। ইমার্জেন্সির সামনে থামছে পরপর অ্যাম্বুল্যান্স। স্ট্রেচারে রোগীকে নামানো হচ্ছে দ্রুত। কিন্তু তার পরেই থমকে যাচ্ছে গতি। ইমার্জেন্সির অদূরে রোগী নিয়ে দাঁড়ানো অ্যাম্বুল্যান্সের দিকে তাকাতেই দেখা গেল, আধবোজা চোখে আচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে এক বৃদ্ধা। স্যালাইনের বোতল উঁচু করে ধরে রেখেছেন পাশে বসা এক মহিলা। জানা গেল, কেন্দ্রীয় আয়কর অফিসের চত্বরে ছোট্ট খাবারের দোকান চালান অমিয়াদেবী। পঁচাত্তর বছরের ওই বৃদ্ধা এ দিন সকাল ৮টা নাগাদ সেখানেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আচমকা ঘরের মধ্যে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান। সঙ্গে সঙ্গে বারুইপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে যান বোনপো অমর দত্ত এবং নাতি প্রদীপ দত্ত। সেখানেই করানো সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে ধরা পড়ে, অমিয়াদেবীর মাথায় রক্ত জমাট বেঁধেছে। বলা হয়, নিউরো সার্জন দেখাতে হবে। কিন্তু ওই সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে কোনও নিউরো সার্জন নেই! তাই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে রেফার করা হয়। সেখানেও একই কথা বলা হয়। উপরন্তু লিখিত কোনও কাগজ ছাড়াই তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় এনআরএসে।
প্রদীপ দত্ত (অমিয়া দাসের নাতি):
সরকারি অফিস চত্বরে কেক-বিস্কুটের দোকান দিয়ে আমাদের সংসার চলে। কোনও মতে ১৮০০ টাকা জোগাড় করে অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে এলাম। কিন্তু এখনও ঠাকুরমাকে ডাক্তারই দেখাতে পারলাম না। কর্মঠ মানুষটা জানি না বিনা চিকিৎসায় কত ক্ষণ পড়ে থাকবেন! ইমার্জেন্সি থেকে বলল, টিকিট করে আনুন। টিকিট কাউন্টার থেকে বলে দিল, আজ কোনও নিউরো সার্জন নেই! এমন মুমূর্ষু রোগী যাবেন কোথায়?
শৈবাল চট্টোপাধ্যায় (অধ্যক্ষ, এনআরএস হাসপাতাল):
হাসপাতালে নিউরো সার্জন রয়েছেন চার জন। নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক এক জন। এ দিন মেডিসিনের ওই চিকিৎসকেরই থাকার কথা। তবে তাঁর একার পক্ষে তো সব সামলানো সম্ভব নয়। ইন্ডোরে রোগীর চাপ থাকলে তিনি আসেন না। এ জন্য সমস্যা তো হচ্ছেই। তবে এ দিন কী হয়েছে, বলতে পারব না। হাসপাতালের বাইরে আছি।
সৌরভ চট্টোপাধ্যায় (সুপার, এনআরএস হাসপাতাল):
আউটডোরে নিউরো সার্জন বসেন মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনিবার। শুধু শুক্রবারই নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক বসেন। এ ক্ষেত্রে তো ইমার্জেন্সিতেই চিকিৎসা করার কথা ছিল ওই বৃদ্ধার। রোগীকে চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে প্রয়োজন মনে করলে ভর্তি নিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু এ দিন কেন তা হয়নি, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
নিউরো মেডিসিন হোক বা নিউরো সার্জারি, ইমার্জেন্সিতে রোগী এলে স্নায়ুরোগের কোনও চিকিৎসক না দেখেই রোগীকে বিদায় করে দেবেন? সুপার ও অধ্যক্ষ দু’জনেই মেনে নিয়েছেন, তা হওয়ার কথা নয়। জানিয়েছেন, তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখবেন। প্রশ্ন হল, খোঁজ নিয়ে কী ব্যবস্থা নিলেন তাঁরা, তা কি জানা যাবে? নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ওই রোগীকে ভর্তির ব্যবস্থা কি করবেন তাঁরা?
উত্তর মেলেনি।
রোগী প্রত্যাখ্যানের এই চিত্র প্রসঙ্গে কী বলবেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র? এ দিন তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ধরেননি। মেসেজেরও উত্তর দেননি।