মুখ রক্ষা: শহরে দূষণ থেকে বাঁচতে স্কুলপড়ুয়াদের মুখে মাস্ক। ছবি: সুমন বল্লভ।
যানবাহন, বিশেষত পুরনো গাড়ির ধোঁয়া থেকে দূষণ তো ছড়াচ্ছেই। কিন্তু শহরের নির্মাণস্থলগুলি যে ভাবে ক্রমশ দূষণের উৎস হয়ে উঠছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ। এমনকি, বায়ুদূষণ রোধে ‘ব্যর্থ’ হওয়ার কারণে মঙ্গলবারই রাজ্যকে যে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় পরিবেশ আদালত, সেখানে দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে নির্মাণস্থলের দূষণকে দায়ী করা হয়েছে। নির্মাণস্থলের দূষণ কমাতে কলকাতা পুরসভার ‘নিষ্ক্রিয়তা’, পরিবেশবিজ্ঞানী-গবেষকদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
নির্মাণস্থলের দূষণে নজরদারি চালানোর জন্য গত বছরের শেষে কলকাতা পুরসভার সঙ্গে একটি বৈঠকে বসেছিল পরিবেশ দফতর। সেখানে নির্মাণস্থলের দূষণ কী ভাবে কমানো যায়, তার রূপরেখাও তৈরি করা হয়েছিল। এর পরেই জারি করা পুর নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, ধুলো-দূষণ কমাতে বালি, সিমেন্ট-সহ ইমারতি দ্রব্য ঢেকে রাখার কথা।
ওই দ্রব্য লরিতে করে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়ার সময়েও তা পুরো ঢেকে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেই নির্দেশিকা ১৬টি বরো অফিসে পাঠানো হয়েছিল। পাশাপাশি, অধস্তন পুরকর্মীদের বিষয়টি দ্রুত জানিয়ে দিতে বরোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারদেরও বলা হয়েছিল। বছর ঘোরার পরে দেখা যাচ্ছে, নজরদারি তো দূর, নির্মাণস্থলের দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে সব পদক্ষেপ করার কথা ছিল, তা কিছুই হয়নি।
আরও পড়ুন: ‘স্তন্যপান করান শৌচালয়ে’, বিতর্কের ঝড়ে শপিং মল
পুর আধিকারিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, সাধারণত বিল্ডিংয়ের নকশা অনুমোদনের সময়ে জানানো হয়, নির্মাণস্থলে দূষণ রোধে কী কী নিয়ম মানতে হবে। নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকেও সেটা মানতে বলা হয়। না হলে নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়ার কথা।
এমন নির্মাণস্থলগুলি হয়ে উঠছে দূষণের উৎস। নিজস্ব চিত্র
ব্যস ওই টুকুই! কারণ, নিয়ম না মানার জন্য নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে নেই বলেই জানাচ্ছেন পুরকর্তাদের একাংশ। এক পদস্থ পুর আধিকারিকের কথায়, ‘‘পুরসভার সেই লোকবল নেই যে শহর ঘুরে কোথায় নির্মাণস্থলে দূষণ হচ্ছে, তা দেখা হবে। নির্মাণের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদেরই সেটা দেখার কথা!’’
আরও পড়ুন: অ্যাসিড-কাণ্ডে এখনও ধরা পড়ল না অভিযুক্ত
পুরসভা সূত্রের খবর, বছরে শহরে কমপক্ষে আড়াই হাজার নির্মাণের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই নির্মাণস্থলগুলিতে পড়ে থাকা বালি, সিমেন্ট-সহ ইমারতি দ্রব্য থেকে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বাড়ে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশ। সে দিকে নজর না দিলে সার্বিক দূষণ রোধ করা যাবে না বলে মত তাঁদের। বুধবারই পরিবেশ সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে নির্মাণস্থলের দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। তিনি বলেন, ‘‘শহরের দূষণের অন্যতম কারণ নির্মাণস্থলের দূষণ। অনেক খোলা জায়গাতেই সিমেন্ট গাড়ি থেকে ওঠানো-নামানো হয়। ফলে দূষণ তো হয়ই।’’
কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টিং’-এর বিজ্ঞানী উপল সাহা জানাচ্ছেন, নির্মাণস্থলগুলি এক একটি ‘হিট আইল্যান্ড’। কারণ, কংক্রিটের যে কোনও নির্মাণই তাপ ধারণ করে। ফলে সেই নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। শুকনো জায়গায় যেহেতু ধুলোবালি ওড়ে, তাই নির্মাণস্থলের বালি ও সিমেন্টের কণা বাতাসে মিশে যায়। বাড়তে থাকে ধুলো-দূষণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কাজ চলার সময়ে নির্মাণস্থল ঢেকে রাখার কথা। বা জল দেওয়ার কথা যাতে ধুলো ছড়াতে না পারে। এখানে তা হয় না।’’
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘যে সব জায়গায় নির্মাণের কাজ হয়, সেখানকার সংলগ্ন রাস্তাগুলো সাদা হয়ে যায়। কারণ, সিমেন্ট, বালি লরি করে যাওয়ার সময়ে তা পড়তে পড়তে যায়। সেই সঙ্গে পুরনো বাড়ি যে ভাবে ভাঙা হয়, সেখান থেকে দূষণ ছ়ড়িয়ে পড়ে। যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে রাজ্য ব্যর্থ, নির্মাণস্থলের দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ।’’