ফাইল চিত্র।
ভোট, উৎসবে বিধি লঙ্ঘনে বাড়ছে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা
শান্তনু ঘোষ
ওমিক্রনের আতঙ্ক প্রায় ঘাড়ের কাছে! তার মধ্যে রাত পোহালেই ভোট-যুদ্ধ। আবার বছর শেষের উৎসবের মরসুমে নৈশ বিধিও শিথিল হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষের এই জোড়া উচ্ছ্বাস শহরে তৃতীয় ঢেউকে কতটা উস্কে দিচ্ছে, তা নিয়েই আশঙ্কার মেঘ জমছে। শঙ্কিত চিকিৎসক মহল জানাচ্ছে, যে কোনও ভিড় বা জমায়েত করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর পক্ষে আদর্শ। আর ওমিক্রন প্রজাতির ভাইরাস অনেক দ্রুত গতিতে ছড়ায়।
রাজ্যে এখন দৈনিক সংক্রমণ ৫০০ থেকে ৮০০-র ঘরে ঘোরাফেরা করছে। চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, সংখ্যাটি এক হাজারের ঘরে প্রবেশ করলেই বুঝতে হবে তৃতীয় ঢেউ শুরু হতে চলল। কারণ দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগে দৈনিক সংক্রমণ অনেক কমে গেলেও সেটি এক হাজারের ঘরে প্রবেশ করার পরেই সংক্রমণের পারদ চড়চড় করে উঠতে শুরু করেছিল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই বলেন, ‘‘বিজয় মিছিল বা বড়দিন ও বর্ষশেষের পার্টিগুলি যে কোনও সময়ে সুপার স্প্রেডার হয়ে উঠতে পারে। ওমিক্রনের ভয় যে হেতু এখন আমাদের ঘাড়ের কাছে, তাই সমস্ত ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন।’’
পুরভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকে প্রচারে মাস্ক পরা, দূরত্ব-বিধি মেনে চলা ও করোনা সচেতনতার কথা বলতে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের বার বার অনুরোধ করেছেন চিকিৎসকেরা। প্রচারপর্বের বাস্তব চিত্র অবশ্য বলেছে অন্য কথা। প্রতিশ্রুতির আওয়াজে শহরের বড় রাস্তা থেকে পাড়ার গলি গমগম করলেও করোনা-বিধি কার্যত উধাও হয়েছে প্রায় সর্বত্রই। রাত পোহালেই আজ, রবিবার সকাল থেকে ভোট-যুদ্ধের ময়দান সরগরম হবে।
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ, প্রতিটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে কোভিড-বিধি মানতে হবে। প্রশ্ন হল, শহরবাসী কি সেই নিয়ম মেনে চলবেন? ভোটের লাইনে গাদাগাদি করে দাঁড়ানো, থুতনিতে মাস্ক ঝোলানো ছবির কি পরিবর্তন হবে?
চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, ‘‘নিয়ম না মানলে বিধানসভা ভোটের পরবর্তী সময়ের ছবিটা ফিরে আসতে বেশি সময় হয়তো নেবে না।’’ এক শ্রেণির মানুষের দাবি, প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ় তো নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রতিষেধক কখনওই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের একমাত্র অস্ত্র নয়, তা বার বার জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। আবার ভোট মিটলেই শহরে শুরু হবে বর্ষশেষের উৎসব। সম্প্রতি রাজ্য সরকার নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে, বড়দিন এবং বছরের প্রথম দিনের অনুষ্ঠান উপলক্ষে আগামী ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত নৈশ নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। রেস্তরাঁ, বার সবই গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকবে। এই বিধি শিথিলতায় উচ্ছ্বসিত শহরবাসীর একটি অংশ।
চিকিৎসক মহল অবশ্য তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার জানাচ্ছেন, করোনাভাইরাস এক জনের থেকে আর এক জনের শরীরে ছড়ায়। সেই জায়গায় ওমিক্রন প্রজাতি আরও বেশি ছোঁয়াচে। তিনি বলেন, ‘‘দু’বছর ধরে যে দূরত্ব-বিধি, মাস্ক পরা, বার বার হাত ধোয়ার কথা বলা হয়েছিল, সেগুলিই ভাইরাস প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার। সেখানে ভোটের লাইন বা বছর শেষের উৎসবের ভিড়ে ওই সমস্ত বিধি কতটা মেনে চলা সম্ভব, সেটা বলা মুশকিল। আর তা না মানলে সংক্রমণ ছড়ানোর পথ যে সুগম হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’’
শেষ কয়েক দিনে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের প্রকাশিত বুলেটিনে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় দৈনিক আক্রান্ত একশোর ঘরে নেমেও কী ভাবে আবার দুশোর ঘরে উঠেছে। যেমন, ডিসেম্বরের ৭-এ ১৩৭, ৮-এ ১৮৩, ৯-এ ১৬৫, ১০-এ ২০৬, ১১-য় ২০৫, ১২-য় ২১৭, ১৩-য় ১৩৫, ১৪-য় ১৬১, ১৫-য় ১৯৬, ১৬-য় ২১৬ জন আক্রান্ত (সবই বিগত ২৪ ঘণ্টার হিসাব)।
রাজ্যের কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা, চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, ‘‘ছাইচাপা আগুন খুবই মারাত্মক। আগুনের ফুলকি উড়ে গিয়ে কার ঘর জ্বালাবে, তা আগাম বলা মুশকিল।
প্রতিবেশী রাজ্যে যখন ওমিক্রন দ্রুত হারে ছড়াচ্ছে, সেখানে আমরা একেবারে নিরাপদ, এমন ভাবনা বোধহয় অমূলক। তাই উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা না হয়ে, ভাইরাসকে ঠেকাতে সচেতনতায় জোর দিতে হবে। যাতে ওমিক্রনের থাবায় নতুন বছরে আবার ক্ষতির খতিয়ান দীর্ঘ না হয়।’’