খদ্দেরের অপেক্ষায়। পাতিপুকুর মাছ বাজারে, শনিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
একে শীত, তার উপর সামনেই বিয়ের মরসুম। ফি বছর এই সময়েই মাছের চাহিদা বাড়ে সব থেকে বেশি। কোনও বছর এমনও হয়, দ্বিগুণ মাছ আমদানি করেও চাহিদা কুলোনো যায় না।
এ বছর একেবারেই উল্টো চিত্র। হাওড়া, পাতিপুকুর ও শিয়ালদহ— কলকাতার তিন পাইকারি মাছের বাজারেই ব্যবসা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। আমদানিও কমেছে গড়ে ৭০ শতাংশ। এর জেরে প্রমাদ গনতে শুরু করেছেন আড়তদারেরা। কারণ তাঁরা জানেন না কবে বাজারে নগদ অর্থের জোগান বাড়বে।
পাতিপুকুর মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক কমল দাস জানান, অন্য সময় যেখানে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই প্রতি দিন ১৪-১৬ গাড়ি মাছ ঢোকে, এখন আসছে ৩-৪ গাড়ি। ওড়িশা থেকেও মাছ আসছে নামমাত্র। রাজ্যের বাইরে ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে ৫০০, ১০০০ টাকার নোট একেবারেই বাতিল হয়ে গিয়েছে। নতুন ১০০ ও ২০০০ টাকার নোটের অভাব। ফলে বড় আড়তদারদের ব্যবসা চালানো অসম্ভব হয়ে উঠছে।
হাওড়া পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ আনোয়ার মকসুদেরও দাবি, প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানি কমেছে। ফলে রাজ্যের মাছ ব্যবসায়ীরা তো বটেই, এমনকী ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে যে সমস্ত ব্যবসায়ী পশ্চিমবঙ্গে মাছ পাঠান, তাঁরাও টাকা পাচ্ছেন না বলে মাছ পাঠাতে পারছেন না। পরিস্থিতি এমনই যে পাইকারি বাজার কার্যত বন্ধ করে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেই তাঁর দাবি।
শনিবার পাইকারি বাজারে প্রায় সকলের মুখেই এক কথা— ঘরে টাকা থাকলেও, তার দাম নেই। আবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকেও চাহিদা মতো টাকা তোলার উপায়ও নেই। খুচরো বাজারের ব্যবসায়ীরা ৫০০, ১০০০ টাকার নোট নিয়ে আসছেন, ফলে হয় তাদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে, নয়তো ধারে মাছ দিতে হচ্ছে। উল্টো দিকে, হাতে টাকা নেই বলে বেশি মাছ আমদানিও করা যাচ্ছে না। যেটুকু হাতে থাকছে, তা দিয়েই ব্যবসা চালাতে হচ্ছে।
বাজারে টান পড়েছে স্থানীয় ভেড়ি ও পুকুরের মাছেরও। কারণ অচল নোটে আর মাছের কারবার হচ্ছে না। তাই পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনার ভেড়ি মালিকেরাও জল থেকে মাছ তুলতে সাহস পাচ্ছেন না। শীতের এই সময়ে যেখানে জ্যান্ত ট্যাংরা, টাটকা পার্শে, মাঝারি ওজনের ভেটকি-বাগদা-গলদায় বাজার ভরে যায়, সে সব মাছের জোগান এখন অনেক কম। দামও বেশ চ়ড়া।
এ দিন কলকাতার খুচরো বাজারগুলিতে একটু বড় ট্যাংরা বিক্রি হয়েছে ৪৫০-৫০০ টাকা কেজিতে। পার্শে ৩৫০-৪০০ টাকা, গলদা ৫০০-৬০০, বাগদা ৭০০-৮০০ টাকা কেজি। অন্য সময় এই মাছ সকালেই শেষ হয়ে যায়, এ দিন বেলা ১২টাতেও বহু ব্যবসায়ীকে ট্যাংরা, চিংড়ি নিয়ে বসে থাকতে গিয়েছে।
পাতিপুকুর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী উত্তম হাজরার কথায়, ভেড়িতে মাছের অভাব নেই। কিন্তু ৫০০, ১০০০ টাকার নোট ভেড়ি মালিকেরা নিতে চাইছেন না। তাই জল থেকে মাছও তুলছেন না। অন্য বছর এই সময় ব্যবসা ভাল হয়। কিন্তু এ বার নগদের টানাটানিতে, আড়তদার থেকে খুচরো ব্যবসায়ী সবাইকে ভুগতে হচ্ছে। খুচরো ব্যবসায়ীরা প্রতি দিন ব্যবসা করে যেটুকু চালু নোট জোগার করতে পারছেন, তাই দিয়েই অল্প অল্প করে মাছ কিনছেন। নয়তো ধারে নিতে হচ্ছে।
হাওড়া পাইকারি বাজারের আড়তদার প্রমোদ সিংহের কথায়, যেটুকু ব্যবসা হচ্ছে তার বেশির ভাগটাই ধার-বাকিতে। কারণ আড়তে সামান্য হলেও মাছ আনতে হবে, না হলে ব্যবসা ধরে রাখা যাবে না। আবার বিক্রি করতে গেলে খুচরো ব্যবসায়ীদের বাকিতেই মাছ দিতে হচ্ছে।
এই তিন পাইকারি বাজারের মাছই খুচরো বিক্রেতাদের হাত ধরে সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু নগদের ধাক্কায় তিন বাজারের ব্যবসাই এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। টানা এ রকম চলতে থাকলে, কিছু দিনের মধ্যে মাছ আমদানিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা আড়তদারদের।