বর্ষবরণ: মধ্যরাতের জনস্রোত সামলাচ্ছে পুলিশ। ছবি: নিজস্ব চিত্র।
উচ্ছৃঙ্খলতার ছবি
ভেঁপুর আওয়াজ ছাপিয়ে কানে ঢুকছিল হুইসল! বর্ষবরণের রাতে পার্ক স্ট্রিটে ভিড় সামলাতে এ বার নতুন কায়দা নিয়েছিল পুলিশ। ভিড়কে জমতে দেয়নি তারা। এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে অন্য প্রান্ত দিয়ে এলাকা ছেড়েছেন লোকজন। ফলে পার্ক স্ট্রিট জুড়ে ফি বছর যে উচ্ছৃঙ্খলতার ছবি দেখা যায়, এ বার তা ছিল অনেকটাই কম। বড় ধরনের কোনও ঘটনাও ঘটেনি। এর মধ্যেও কিছু উঠতি বয়সের যুবকের দল বেচাল করেছে। তাতে অবশ্য অনেকের কপালেই জুটেছে ধমক, কারও কারও ক্ষেত্রে ঠ্যাঙানিও। তবে বেসামালদের সামলাতে কিছু ক্ষেত্রে মুশকিলেও পড়েছেন পুলিশকর্মীরা। রাত ১২টা নাগাদ দুই তরুণী টলোমলো পায়ে এসে এক পুলিশ অফিসারের কাছে একটি হোটেলে পৌঁছনোর রাস্তা জিজ্ঞাসা করলেন। পথ দেখানোর পরে তাঁরা ঠিক উল্টো পথে! এক মত্ত মোটরবাইক চালককে পাকড়াও করেছিল পুলিশ। বাইক থেকে নামতেই ভূমিশয্যা নিলেন তিনি।
শহরের অন্যান্য প্রান্তেও বর্ষবরণের রাতে অসভ্যতার নজির রয়েছে। গরফা এলাকায় জোর করে গাড়িতে তুলে এক তরুণীকে অপহরণের চেষ্টা করেছিল এক মত্ত যুবক। কিন্তু দুই মোটরবাইক আরোহীর সক্রিয়তায় রক্ষা পেয়েছেন তিনি। অন্য দু’টি ঘটনায় বেলেঘাটায় বাড়ির সামনে মদ্যপানের প্রতিবাদ করলে এক মহিলাকে নিগ্রহ করা হয়েছে এবং শিয়ালদহে ইএসআই হাসপাতালের সামনে এক তরুণীকে কটূক্তির প্রতিবাদ করায় বেধড়ক মারধর করা হয় তাঁর সঙ্গীকে। উত্তর কলকাতার কিছু অলিগলিতেও মত্ত যুবকদের দাপাদাপি দেখা গিয়েছে।
দূষণে স্বাগত
বছরভর দূষণের দাপটে অতিষ্ঠ ছিল কলকাতা। বর্ষবরণের রাতেও মহানগরীর কপালে জুটল সেই দূষণই। সন্ধ্যার পর থেকেই শহর ও শহরতলির অলিগলিতে বাজতে শুরু করেছিল পেল্লায় মাপের সাউন্ড বক্স, চলতি কথায় ‘ডি জে বক্স’। সেই শব্দের দাপটে অতিষ্ঠ হয়েছেন মানুষজন। শব্দবাজি যেমন ফেটেছে, তেমনই ফেটেছে আতসবাজি। রাতে কলকাতার দূষণ-চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া বায়ুদূষণের সূচকের তথ্যে। রবিবার রাত ১২টা থেকে সোমবার ভোর চারটে পর্যন্ত এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৩৩২, ৩৩৬, ৪০২, ৩৯০ ও ৩৩৩। এই সূচক ৩০০ পেরোলেই বায়ুদূষণের মাত্রা বিপজ্জনক হিসেবে গ্রাহ্য হয়। পরিবেশবিদেরা জানান, শীতের রাতে এমনিতেই দূষণ বাড়ে। তার উপরে আতসবাজির ধোঁয়ায় তা আরও বেড়েছে। এক পরিবেশকর্মী বলছেন, ‘‘শব্দ ও বিপজ্জনক বায়ুদূষণ দিয়েই নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে কলকাতা।’’ আতসবাজি না হয় নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু ডি জে এবং শব্দবাজি তো নিষিদ্ধ। তা হলে সেগুলি এত উপদ্রব চালাল কী ভাবে?
লালবাজার সূত্রে খবর, শব্দবাজি অথবা ডি জে বক্স ব্যবহার করার জন্য কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। অথচ, নিমতলা ঘাট এলাকায় রাত বারোটার পরেও দেদার বক্স বেজেছে। রাত বারোটায় পার্ক স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আশপাশের এলাকা থেকে নাগাড়ে বাজির শব্দ কানে এসেছে। শহরতলির অবস্থাও তথৈবচ! সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত ডি জে বাজিয়ে জলসা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, এ সবে স্থানীয় রাজনৈতিক মদত থাকে। তাই অশান্তি এড়াতে অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ‘‘জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করেন না কেউ। তাই স্থানীয়রাও অভিযোগ জানাননি,’’ মন্তব্য এক পুলিশকর্তার। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, উৎসবের মরসুম শুরু হওয়ার আগেই বাজি এবং ডি জে নিয়ে নিষেধাজ্ঞা পুলিশকে পাঠানো হয়েছিল। যদিও এক পরিবেশকর্মী বলছেন, ‘‘পরিবেশ রক্ষায় পর্ষদের কাজ এখন বিবেকের ভূমিকা নিয়েছে। অথচ, তারা একটু চাপ দিলেই অনেক কাজ হয়। তার প্রমাণ আগে একাধিক বার মিলেছে।’’
দু’চাকার দাপট
রাত একটা। এ জে সি বসু রোড। বিপজ্জনক গতিতে ছুটে চলেছে তিনটি মোটরবাইক। এক-একটিতে তিন জন করে আরোহী। কারও মাথাতেই হেলমেট নেই। রাত দুটোয় চেতলায় বেসামাল অবস্থায় মোটরবাইক নিয়ে আছাড়় খেতে দেখা গিয়েছে দুই যুবককে। রাত সওয়া তিনটেয় ইকো পার্কের কাছে হুস করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল একটি মোটরবাইক। মাথায় হেলমেট নেই। একই ছবি রাতের যশোর রোডেও। সেখানে মোটরবাইক আরোহীদের দেখে বোঝা মুশকিল, এই শহরে আদৌ ট্র্যাফিক আইন আছে কি না! বছরভর ট্র্যাফিক বিধি ভাঙার নিরিখে সবার উপরে থাকেন মোটরবাইক আরোহীরা। বর্ষবরণের রাতেও শহর ও শহরতলির রাস্তায় দেখা গেল একই ছবি। তবে এটাও ঠিক, কলকাতার কিছু কিছু এলাকায় পুলিশি সক্রিয়তা ছিল। পার্ক স্ট্রিটে নিয়ম ভেঙে মোটরবাইক চালালেই পুলিশ পাকড়াও করেছে। যাদবপুরের একাধিক জায়গায় ‘ব্রেথ অ্যানালাইজার’ নিয়ে মোতায়েন ছিলেন পুলিশকর্মীরা। মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালালেই পাক়়ড়াও করা হয়েছে। জরিমানা, গা়ড়ি বাজেয়াপ্তও করা হয়েছে। এ জে সি বসু রোড ও পরমা উড়ালপুলে মোটরবাইক রেস চলে বলে অভিযোগ ছিল। রবিবার রাতে দেখা গেল, এসএসকেএম হাসপাতালের কাছে এ জে সি বসু রোড উড়ালপুলের কাছে গার্ডরেল দিয়ে রাস্তা সরু করে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ। নজর ছিল বিভিন্ন পানশালা থেকে বেরোনো মোটরবাইক ও গাড়িচালকদের দিকেও। পুলিশের একাংশ বলছেন, নজরদারি ছিলই। তবু তার ফাঁক গলে কেউ কেউ বেরিয়ে গিয়েছেন। তবে এক মোড়ে ফাঁকি দিয়ে পরের কোনও মোড়ে কেউ ধরা পড়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
ধরপাকড়ের হিসেব
বছরের শুরুটা ভাল গেল না এ শহরের অন্তত ১৩৯ জনের! কারণ, বর্ষবরণের রাতটা তাঁদের হাজতেই কাটাতে হয়েছে। লালবাজারের হিসেবে, রবিবার রাতে গোটা শহরে বিশৃঙ্খলা ও অভব্য আচরণের জন্য মোট ১৩৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সব থেকে বেশি লোক গ্রেফতার হয়েছে দক্ষিণ কলকাতা ডিভিশনে। এক পুলিশকর্তার মন্তব্য, ‘‘প্রতি বছরই গ্রেফতারে দক্ষিণ এগিয়ে থাকে। কারণ, পার্ক স্ট্রিট চত্বর ওই ডিভিশনের আওতায় পড়ে।’’ এ ছাড়াও, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতা ডিভিশনে ২৪ ও ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লালবাজারের খবর, পথ দুর্ঘটনা রুখতে মত্ত ও বেপরোয়া গা়ড়ি-মোটরবাইক চালকদের উপরেও নজরদারি ছিল। হেলমেট ছাড়়া বাইক চালানোর অভিযোগে ৩৪৪ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালানোর জন্য ৬২ এবং মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য ৯৩ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, নথিপত্র ছাড়াই গাড়ি রাস্তায় নেমেছে। সেই গাড়িগুলিকে আটক করা হয়েছে।