হাই-প্রোফাইল। একে মেয়র, তায় পরিবেশমন্ত্রী। তাঁর এমন ‘অ-শোভন’ হাঁ মুখ! ঢাকতে তৎপর অরুণিমা ঘোষ। অন্য পাশে দেবাশিস কুমার। শনিবার, আলিপুরে পরিবেশ দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
কলকাতা শহরে আর কাউকে মাটির নীচের জল খেতে হবে না। শহরে থাকবে না কোনও গভীর নলকূপ। বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আগের দিন, শনিবার এমনই সিদ্ধান্তের কথা জানান নবনিযুক্ত পরিবেশমন্ত্রী তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। এমনকী, আগে বাড়ির কমপ্লিশন সার্টিফিকেট (সিসি) না পেলে জলের সংযোগ দেওয়া হতো না। পরিবেশের কথা ভেবে সেই নিয়মেও ছাড় দিতে চলেছে পুরসভা। এ বার থেকে বাড়ির কর দেওয়ার রশিদ দেখালেই জলের সংযোগ দেওয়া হবে। মাটির নীচ থেকে জল তোলা কমাতেই এই উদ্যোগ বলে জানান মেয়র। নতুন ওই ঘোষণায় শহরের কলোনি এলাকা থেকে শুরু করে বহুতল, আবাসনের বাসিন্দারও ওই সুবিধা পাবেন বলে জানান মেয়র। তিনি বলেন, ‘‘জল তো রয়েছে, তা দিতে অসুবিধে নেই।’’
শপথের পরে দায়িত্ব নিয়েই পরিবেশমন্ত্রী বুঝেছিলেন, কলকাতার পরিবেশ রক্ষার কাজে পুরসভা কার্যত ‘ব্যর্থ’। সেখানে মেয়র শোভনের সমালোচনা করতেও পিছপা হননি মন্ত্রী শোভন। পুরমহলে প্রশ্ন উঠেছিল, শহর জুড়ে যে ভাবে পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে, তার দায় এড়াতে পারেন না মেয়র এবং তাঁর পুরবোর্ড। কলকাতায় দূষিত হচ্ছে গঙ্গার জল, যত্রতত্র চামড়ার কারখানা, প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় রীতিমতো দফারফা শহরের। পরিবেশের উপরে ক্রমাগত আক্রমণের চাপ কতটা সামাল দিতে পারবেন জানতে চাওয়া হলে মেয়রের জবাব ছিল, ‘‘দিন কয়েক যাক, দেখুন কী হয়।’’
এ দিন পরিবেশমন্ত্রী কলকাতায় পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মেয়র হিসেবে যা ‘করতে পারেননি’ এ বার পরিবেশ দফতরের মন্ত্রী হয়ে জোর দিতে চান শহরের সেই ‘সুস্থতা’য়। দীর্ঘকাল থেকে প্রতিনিয়ত গভীর নলকূপের সাহায্যে মাটির নীচ থেকে জল তুলে দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায় তা সরবরাহ করা হচ্ছে। সেখানে পরিস্রুত পানীয় জল দিতে না পারার কারণেই মাটির তলা থেকে জল তুলতে হচ্ছে পুরসভাকে। শুধু পুরসভার নয়, এই সব এলাকায় কয়েক লক্ষ বাসিন্দাও নিজের সুবিধামতো গভীর নলকূপ বসিয়ে জল তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর তাতেই দ্রুত মাটির নীচে জলস্তর কমে যাচ্ছে। যা সুস্থ পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ভযঙ্কর বিপদ বলে মত পরিবেশবিদদের। জলস্তর কমে গেলে যে কোনও সময়ে বড়সড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে সকলকেই। তাই গভীর নলকূপের সংখ্যা কমানো ভীষণ দরকার। এ নিয়ে বারবার পুরসভার বিরুদ্ধে ‘অক্ষমতার’ অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু পানীয় জলের প্রয়োজনে সে সব সমালোচনায় ততটা আমল দেননি মেয়র। এখন তিনি পরিবেশমন্ত্রী হওয়ায় ওই ঘটনা তাঁকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
শহরের গভীর নলকূপের ব্যবহার নিয়ে তাঁর দাবি, ‘‘খুব শীঘ্রই শহর থেকে গভীর নলকূপের পাট উঠিয়ে দেব। শহরের সবাইকে পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করব।’’ আর সেটা যে তাঁর কথার কথা নয়, তা বোঝাতে একটা পরিসংখ্যানও দেন শোভন। তিনি জানান, কলকাতায় এখন প্রতিদিন প্রায় ৪১ কোটি গ্যালন পরিস্রুত পানীয় জল উৎপাদন হয়। পলতা, গার্ডেনরিচ, ধাপায় জয়হিন্দ-সহ আরও কয়েকটি প্রকল্প থেকে ওই পরিমাণ জল উৎপাদন হয়। শহরে বাসিন্দার সংখ্যা লাখ ষাটেক। কেন্দ্রীয় সরকারের গাইডলাইন অনুসারে মাথাপিছু জল লাগে ৪০ গ্যালন। শহরে এখন পরিস্রুত জলের পরিমাণ যা রয়েছে, তাতে সকলকেই তা দেওয়া যাবে। কিন্তু সর্বত্র পাইপলাইন না থাকায় জল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সে কারণেই গভীর নলকূপ রাখতে হয়েছে পুরসভাকে, ব্যাখ্যা শোভনবাবুর। এ বার যাতে শহরের সর্বত্র পাইপলাইনের সংযোগ দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা চলছে বলে জানান শোভনবাবু।
মেয়র জানান, পলতা-টালা প্রকল্প থেকে পরিস্রুত জল সরবরাহের কাজ সুষ্ঠু ভাবেই চলছে। তবে গার্জেনরিচ এবং ধাপায় উৎপাদিত জলের সরবরাহ নিয়ে এখনও কিছু সমস্যা রয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে বুস্টার পাম্পিং স্টেশন করতে হবে। কোথাও আবার ডেলিভারি পাইপ সংযোগ করতে হবে। মূলত টাকার অভাবে পুরো কাজ হয়নি। এ বার পুরসভা, রাজ্য সরকার এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের টাকায় সেই কাজ শুরু করা হচ্ছে। পরিবেশমন্ত্রী তথা মেয়রের কথায়, ‘‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করতে বলা হয়েছে। যত কাজ এগোবে, ততই আমরা গভীর নলূপের ব্যবহার কমাতে থাকব।’’