মৌচাকে ঢিল পড়েছে। আর তাতেই সরব রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলির চিকিৎসক ও নার্সদের একটা বড় অংশ।
হাসপাতালের ইন্ডোরে রোগীর প্রয়োজনে নার্সের দেখা পাওয়া যায় না বহু সময়েই। তা নিয়ে অভিযোগ উঠলে বলা হয়, হাসপাতালে নার্সের সংখ্যা কম। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, নার্সের সংখ্যা কম ঠিকই, কিন্তু যতটা প্রচার করা হয়, ততটা নয়। যত সংখ্যক নার্স রয়েছেন, তাঁদের কাজের বণ্টন সঠিক হলে এই সমস্যা অনেকটাই এড়ানো যেত বলে তাঁদের অভিমত। সেই বণ্টন সঠিক করতেই এ বার সরকারি হাসপাতালের আউটডোর থেকে নার্সদের দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। ঠিক হয়েছে, এ বার থেকে স্ত্রী-রোগ বিভাগ ছাড়া সরকারি হাসপাতালের আর কোনও আউটডোরেই নার্সরা থাকবেন না। তাঁরা ডিউটি করবেন ইন্ডোরেই।
এই সিদ্ধান্তকে ঘিরেই এখন কলকাতা-জেলা নির্বিশেষে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। তাঁদের বক্তব্য, কোনও রোগিণীকে পরীক্ষা করার সময়ে সেখানে হাসপাতালের নার্স বা মহিলা কর্মীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। এর ফলে এক দিকে যেমন রোগিণীরা স্বচ্ছন্দ থাকেন, তেমনই বহু অপ্রীতিকর ঘটনা বা অভিযোগের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা কী ভাবে রোগিণীদের পরীক্ষা করবেন, তার ব্যাখ্যা না দিলে চিকিৎসা বন্ধ রাখবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন কেউ কেউ। আর নার্সদের বক্তব্য, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এমন একটা ব্যবস্থাকে পাল্টানোর আগে তাঁদের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্তাদের কথা বলা উচিত ছিল। স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, এই প্রতিবাদকে তাঁরা মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কারণ তাঁদের মতে, এ সবই ‘কাজ না করার অজুহাত’।
দিন কয়েক আগে এই নতুন ডিউটি প্রোটোকল ঘোষণা করা হয়। তাতে বলা হয়েছে শুধুমাত্র এক জন করে নার্স স্ত্রী-রোগ বিভাগের আউটডোরে থাকবেন। বাকি কোনও আউটডোরে নার্স রাখার প্রয়োজন নেই। দিনের কোন সময়ে নার্সদের ডিউটি কী ভাবে ভাগ করে দেওয়া হবে, স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে তারও। নাইট ডিউটি করলে সেই বাবদ পাওনা ছুটিও নিজের খুশিমতো নেওয়া চলবে না বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যকর্তাদের যুক্তি, প্রয়োজনের তুলনায় বড়জোর ১০ শতাংশ কম নার্স রয়েছেন। বহু ক্ষেত্রেই নার্স থাকলেও তাঁদের ডিউটি এমন ভাবে বণ্টন করা হয় যে, কাজের সময়ে কারও দেখা মেলে না। বিশেষত ইন্ডোরে এই ঘাটতির ছবিটা খুবই প্রকট। সেই ছবি বদলাতেই এমন সিদ্ধান্ত।
স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, ‘‘আউটডোরে নার্সের কতটুকু প্রয়োজন? সেখানে তো নার্সদের থাকারই কথা নয়। এত দিন যে রাখা হয়েছিল, সেটাই ভুল। সেই ভুলটা আমরা সংশোধন করতে চাইছি। নার্সের কাজ রোগীর শয্যার পাশে, অন্য কোথাও নয়।’’
নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনও পুরুষ ডাক্তার কোনও রোগিণীর শারীরিক পরীক্ষা করেন, তা হলে সেখানে এক জন মহিলা কর্মীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। তা হলে এ বার থেকে সেই নিয়ম মানার কী হবে? স্বাস্থ্য সচিব বলেন, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগিণীর সঙ্গে বাড়ির লোকজন থাকেন। তাঁরা উপস্থিত থাকবেন। তা না হলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা রয়েছেন। তাঁদেরও না পাওয়া গেলে ওয়ার্ড থেকে নার্সদের ডেকে নেওয়া হবে। অনেকগুলো সমাধানসূত্র হাতের সামনেই রয়েছে।’’
স্বাস্থ্যকর্তাদের এই বক্তব্য মানতে নারাজ চিকিৎসক ও নার্সদের একটা বড় অংশ। শুক্রবার দিনভর রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের আউটডোর এ নিয়ে বিক্ষোভে সরগরম ছিল। কোথাও ডাক্তারেরা রোগিণীকে পরীক্ষা না করে বসে থেকেছেন, কোথাও আবার নার্সরা জানিয়ে দিয়েছেন, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারি তরফে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা অবশ্যই জরুরি ছিল।
এসএসকেএমের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর তো এমনিতেই আকাল। ইন্ডোরেই থাকেন না, আউটডোরে কী ভাবে তাঁদের দেখা মিলবে?’’ আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অন্য বিকল্পটাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এমনিতেই সরকারি হাসপাতালে প্রচুর সময় লাগে। তার উপরে নার্সদের ওয়ার্ড থেকে ডেকে পাঠালেই যে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবেন, এটা কোনও ভাবেই আশা করা যায় না। ফলে সরকারের এই সিদ্ধান্ত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা মহিলাদের সমস্যা অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে।’’
যদিও চিকিৎসকদের অন্য অংশের মত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁরা বলছেন, ইন্ডোরে রোগী উপচে পড়ে। অথচ নার্সের সংখ্যা কম। তাই ভুল ওষুধ দেওয়া, এক রোগীর জন্য আনানো রক্ত অন্য রোগীকে দেওয়া, মুমূর্ষু রোগীর প্রয়োজনে পাশে না থাকার মতো ঘটনা অহরহ ঘটে। অথচ আউটডোরে নার্সদের কার্যত কোনও ভূমিকাই নেই। আউটডোরের ডিউটি থেকে তাঁদের ইন্ডোরে আনা হলে আখেরে বহু রোগীর প্রাণ বাঁচবে।