ফাইল চিত্র।
উত্তর ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় (বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর) ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হিসেবে কিছু বছর আগে পর্যন্ত ধরা হত বঙ্গোপসাগরকেই। কিন্তু ১১৭ বছরের রেকর্ড ভেঙে ২০১৯ সালে আরব সাগরে চার-চারটি অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ায় আবহবিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান যে, ঘূর্ণিঝড় নিয়ে এত দিনের পুরনো তত্ত্ব আর খাটছে না। কারণ, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে শুধু বাড়ি-ঘরই ভাঙেনি, তার সঙ্গে ভেঙে যাচ্ছে ঝড় সংক্রান্ত যাবতীয় পুরনো ধ্যানধারণাও!
আরব সাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা, লেখালিখি হলেও তা নিয়ে দোলাচলে ছিলেন আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ। কিন্তু দু’বছর আগে আরব সাগরে একে একে অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় (ভেরি সিভিয়র সাইক্লোন) ‘বায়ু’ ও ‘হিকা’, মহা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় (এক্সট্রিমলি সিভিয়র সাইক্লোন) ‘মহা’ এবং সুপার সাইক্লোন ‘কিয়ার’ তৈরি হওয়ায় তা চিরাচরিত ধারণায় পরিবর্তন আনে।
মৌসম ভবনের তথ্য বিশ্লেষণ করে আবহবিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন, বছর ১৫ আগেও উত্তর মহাসাগরীয় এলাকায় বছরে গড়ে পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে তার চারটিই হত বঙ্গোপসাগরে। একটি আরব সাগরে। কিন্তু কয়েক বছর হল তাতে পরিবর্তন হয়েছে। যে পরিবর্তনের প্রতিফলন ধরা পড়েছিল গত বছর কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান দফতর (ইন্ডিয়ান মেটিরিয়োলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট বা আইএমডি) প্রকাশিত দেশের জলবায়ু সংক্রান্ত রিপোর্টেও। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে যে আটটি ঘূর্ণিঝড় দেশে আছড়ে পড়েছিল, তার মধ্যে পাঁচটিই (চারটির প্রাবল্য অত্যধিক ছিল) তৈরি হয়েছিল আরব সাগরে। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছিল শুধু ১৯০২ সালে!
এর কারণ হিসেবে সেই উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন আবহবিজ্ঞানীরা। আইএমডি-র রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠই নয়, ভূপৃষ্ঠের বায়ুর উষ্ণতাও (ল্যান্ড সারফেস এয়ার টেম্পারেচার) ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে ২০০৯-২০১৯, এই এগারো বছরের মধ্যে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭— পরপর এই তিন বছর ছিল উষ্ণতম। আর গত দু’দশক, অর্থাৎ ২০০১-’১০ এবং ২০১০-’১৯ ছিল সব চেয়ে উষ্ণতম (ওয়ার্মেস্ট এভার)।
কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টিং’-এর বিজ্ঞানী উপল সাহা জানাচ্ছেন, আগে বঙ্গোপসাগরের তুলনায় আরব সাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা ০.৫-১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কম থাকত। কিন্তু বর্তমানে উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সৌজন্যে সেই উষ্ণতা প্রায় বঙ্গোপসাগরের মতো হয়ে গিয়েছে। ফলে শুধু সমসংখ্যক ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়াই নয়, এমনও দেখা যাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় আরব সাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য বেশি হচ্ছে। উপলবাবুর কথায়, ‘‘গত বছর বঙ্গোপসাগরে যেমন আমপান তৈরি হয়েছিল, আরব সাগরে তৈরি হয়েছিল নিসর্গ। আবার এই বছরে আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড় টাউটে তৈরি হল। তার পরপরই বঙ্গোসাগর থেকে ধেয়ে এল ইয়াস।’’
কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান দফতরের তথ্য আরও জানাচ্ছে, উত্তর ভারত মহাসাগরীয় এলাকায়, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সম্মিলিত ভাবে সব থেকে কম ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। মাত্র একটি। আর সব থেকে বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল ১৮৯৩, ১৯২৬, ১৯৩০ ও ১৯৭৬— এই চারটি বছরে। ওই সব ক’টি বছরেই বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল ১০টি ঘূর্ণিঝড়। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিরিয়োলজি’-র এক বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, কিছু বছর আগেও বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে যত নিম্নচাপ তৈরি হত, তার মধ্যে ৩৫ শতাংশ ঘূর্ণিঝড়, ১৬ শতাংশ শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং ৭ শতাংশ অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আকার নিত। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অতি শক্তিশালী ও মহা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে।’’
আর আরব সাগরে তৈরি হওয়া টাউটে বা বঙ্গোপসাগরের ইয়াস সেই প্রবণতারই প্রতিফলন বলে জানাচ্ছেন আবহবিজ্ঞানীরা!