রয়্যাল কুকুর রহস্য

রয়্যাল কুকুর রহস্য! কে সেই কুকুর যার জন্য এসএসকেএম হাসপাতালের অধিকর্তা (এখন অপসারিত) প্রদীপ মিত্রকে এসএমএস পাঠিয়ে নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান রাজেন্দ্র পাণ্ডে লেখেন, ‘‘নিড ট্রিটমেন্ট অব আ ভিভিআইপি ডগ’’!

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০৩:৫৭
Share:

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

রয়্যাল কুকুর রহস্য!

Advertisement

কে সেই কুকুর যার জন্য এসএসকেএম হাসপাতালের অধিকর্তা (এখন অপসারিত) প্রদীপ মিত্রকে এসএমএস পাঠিয়ে নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান রাজেন্দ্র পাণ্ডে লেখেন, ‘‘নিড ট্রিটমেন্ট অব আ ভিভিআইপি ডগ’’! কে সেই কুকুর যার জন্য রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি তৃণমূলের নির্মল মাজি থেকে শুরু করে রাজেন্দ্রবাবুর মতো প্রবীণ চিকিৎসক মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন! অধিকর্তা প্রদীপবাবু বদলি হয়ে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে চলে যান!

তবে কি না কুকুরের ‘ওজন’ তো আর কুকুরের নয়! ভিভিআইপি প্রভুর ‘ওজনে’ই যে কুকুর ভিভিআইপি, তাতে বিশেষ সন্দেহ থাকার কথা নয়। তা হলে কে সেই ভিভিআইপি? কেন আড়ালে রাখা হচ্ছে তাঁর নাম? কেন এসএসকেএমের খাতায় ডায়ালিসিসের লগবুকে ‘ভিভিআইপি’ কুকুরকে ‘আননোন’ (পরিচয়হীন) তকমা দেওয়া হয়েছিল? কে দেবে তার প্রভুর সন্ধান?

Advertisement

অনুসন্ধান শুরু।

এখন বঙ্গে ভিভিআইপি বলতে প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে, তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পদাধিকারে তাঁর পরিবারও যে ভিভিআইপি পরিবার, তা নিয়ে তর্ক নেই। মমতা নিজে কুকুর পোষেন বলে জানা নেই। তবে এক সময়ে তাঁর বাড়ির আঙিনায় সোনালি লোমের ‘লাদেন’ ঘুরঘুর করত। দীর্ঘদিন সেই পথ-কুকুরের দেখা মেলে না। হয়তো সে আর নেই।

ইদানীং কুকুর পোষেন মুখ্যমন্ত্রীর সাংসদ-ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ভিভিআইপি’ সেই কুকুর কি তবে অভিষেকের পোষ্য? ফোনে ধরা হল তাঁকে। প্রশ্ন শুনেই বেজায় উত্তেজিত অভিষেক বললেন, ‘‘আপনাদের কি মতিভ্রম হয়েছে? যা ইচ্ছে তাই বলছেন! আমার দুটো কুকুর আছে। একটা চার মাসের গোল্ডেন রিট্রিভার। অন্যটা বিগল্। তারা অসুস্থ হয়নি। কারও ডায়ালিসিসেরও প্রয়োজন পড়েনি।’’

কিন্তু কানাঘুষো একটা কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে, এ মাসের ১৪ তারিখ একটি গোল্ডেন রিট্রিভারের মৃত্যু হয়। তার মালিকের নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কুকুরটির নাকি ডায়ালিসিস প্রয়োজন হয়েছিল।

পশুচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের চেম্বার ল্যান্সডাউনে। তাঁর কাছেই সাধারণত অভিষেকের কুকুরের চিকিৎসা হয়। গৌতমবাবুকে ফোন করাতে তিনি বললেন, ‘‘আমার কাছে অভিষেকবাবুর একটা বাচ্চা গোল্ডেন রিট্রিভার মাঝেমধ্যে

আসত। তার কখনও ডায়ালিসিসের প্রয়োজন পড়েনি।’’

পার্ক সার্কাসে পশু চিকিৎসক স্বপন ঘোষের চেম্বার। তিনি বললেন, ‘‘আমার কাছে অভিষেকের মায়ের কুকুর আসে। সোনালি রঙের স্পিৎজ্। তার ডায়ালিসিস দরকার হয়নি।’’

কুকুর পোষেন মুখ্যমন্ত্রীর ছোট ভাই বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়ও। একই প্রশ্ন তাঁকেও। জবাবে তিনি যা বললেন, জটায়ু থাকলে অবশ্যই বলতেন, ‘হাইলি সাসপিশাস’! বাবুনের বক্তব্য, ‘‘কুকুরটা আমার, না আমার বাড়ির কারও সে বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না। আমরা একটা কুকুর রয়েছে স্পিৎজ্। তার বয়স ১৬ বছর। এখনও তার ডায়ালিসিসের দরকার পড়েনি।’’

কিন্তু রহস্য যে ঘনীভূত হয়েই চলেছে! কারণ একটি পশু চিকিৎসা ক্লিনিকের কর্তা কিশোর গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে শোনা গেল, ‘‘বাবুনবাবুর যে কুকুরটি এখন আমাদের ক্লিনিকে আসে, সেটি রটওয়েলার। সাধারণত তাদের লেজ কাটা থাকে। এই কুকুরটির অবশ্য লেজ আছে।’’

অতএব কুকুর-রহস্যের জট খুলতে আরও এক বার খোদ নির্মল মাজির সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। মঙ্গলবার তিনি নিজেই বলেছিলেন, যে কুকুরটিকে এসএসকেএমে ডায়ালিসিসে পাঠানোর কথা হয়েছিল, সেই কুকুরটির জন্য ‘দিদি’ (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) খুব মানসিক কষ্ট পাচ্ছিলেন।

শুক্রবার সেই নির্মল মাজিকে আবার প্রশ্ন করা হল, কুকুরটি কি অভিষেকের?

উত্তর: না।

তা হলে কার?

আমি জানি না। এক জন ভেটেরেনারি সার্জন আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।

তিনি কে?

নাম মনে নেই।

ওটি কী জাতের কুকুর ছিল?

বলতে পারব না। সবটাই প্রদীপ মিত্র (এসএসকেএম-এর অপসারিত অধিকর্তা) জানেন।

প্রদীপ মিত্রের কঠোর প্রতিবাদ, ‘‘আমি কিছুই জানি না। আমার সম্পর্কে এ ধরনের কথা সর্বৈব মিথ্যা।’’

হঠাৎ গুঞ্জন ভেসে আসে, কুকুরটি রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের। চন্দ্রিমার সঙ্গে নির্মল মাজির ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা

সুবিদিত। তাই তাঁর কুকুরের জন্য নির্মলবাবু তৎপর হবেন তাও কি সম্ভব! তবু অনুসন্ধানে কোনও সূত্রই হেলাফেলার নয়।

চন্দ্রিমা অবশ্য নিরাশ করলেন । ফোন ধরেই বললেন, ‘‘আমার কোনও কুকুরই নেই। আমি এ ব্যাপারে কোনও কথাও বলব না।’’

হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ভিভিআইপি ঠিকানার বাইরেও বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসেও ‘ভিআইপি’ নেতারা আছেন! তাঁদের কারও কুকুর হতে পারে কি? বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বললেন, ‘‘আমার কোনও কুকুর নেই। ছিলও না কখনও।’’ রাজ্যের একমাত্র বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের শ্লেষ, ‘‘নিজেই খেতে পাই না। কুকুর পুষব কী!’’

লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কুকুর ছিল। কিন্তু সেখানেও মিলিল না সূত্র। কারণ সোমনাথবাবু জানালেন, তাঁর অ্যালসেশিয়ান কুকুরটি গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। তার পরে আর

কুকুর পোষেননি। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুইয়াঁর দাবি, ‘‘আমার কোনও কুকুর নেই। বাবার একটা নেড়ি ছিল। আমার ভাইয়েরও একটা নেড়ি আছে। তার কখনও ডায়ালিসিস লাগেনি। কৃমির ওষুধ আর ভ্যাকসিন নিয়ে দিব্যি আছে।’’

খবর এল, বেলগাছিয়ার পশুচিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দিন আগে একটি কুকুরের ডায়ালিসিসের দরকার হয়েছিল। ধরা হল উপাচার্য পূর্ণেন্দু বিশ্বাসকে। বললেন, ‘‘কিছু দিন আগে আমাদের এখানে একটি গোল্ডেন রিট্রিভারের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ওর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ডায়ালিসিসের প্রয়োজন ছিল। আমাদের এখানে সেই ব্যবস্থা ছিল

না বলে আমরা কুকুরটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। কার কুকুর তা আমার মনে নেই।’’

কে বলতে পারবেন? পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক শ্যামল গুহ জানলেও জানতে পারেন।’’ সেই চিকিৎসককে রাত পর্যন্ত চেষ্টা করেও ফোনে ধরা যায়নি। কখনও কেটে দিয়েছেন। কখনও বা সুইচড অফ।

গোল্ডেন রিট্রিভার তো মুখ্যমন্ত্রীর সাংসদ-ভাইপো অভিষেকেরও আছে, যার ডায়ালিসিসের দরকার পড়েনি বলে তিনি নিজেই দাবি করেছেন। একই জাতের কুকুর আছে সিপিএম নেতা গৌতম দেবের বাড়িতেও। কী বলছেন তিনি? তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার নয়, আমার পুত্রের একটা গোল্ডেন রিট্রিভার আছে। তার নাম ব্রুনো। এখন সে দিব্যি সুস্থ। শরীর খারাপ হলে স্থানীয় এক চিকিৎসককে দেখাই।’’

প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত রয়েই গেল। ফেলুদার মগজাস্ত্র নেই, নেই সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ। বাস্কারভিল কুকুরের রহস্যভেদ করা শার্লক হোমসও নেই।

কী ভাবে হবে পিজি-র কুকুরের কিনারা?

সারদা কাণ্ডে সিবিআই চেয়ে ‘সফল’ হয়েছেন কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। এ বার তাঁর দাবি, ‘‘এসএসকেএম হাসপাতালে কোন ভিভিআইপি কুকুরের ডায়ালিসিসের সুপারিশ করা হল, তা প্রকাশ্যে আসা উচিত। এর জন্য প্রয়োজনে সিবিআই তদন্ত হোক।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement