বিদ্যাসাগর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ওই নাবালিকা। —নিজস্ব চিত্র।
হাসপাতালে ভুল ঠিকানা দিয়েছিলেন নিউ আলিপুরের নাবালিকার মা এবং পরিবারের সদস্যরা। নিউ আলিপুরের ১০ বছরের নাবালিকার অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্যই পেলেন তদন্তকারীরা।
নিউ আলিপুরের ‘ই’ ব্লকের বাসিন্দা ওই নাবালিকার পরিবার কেন বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ঠিকানা ‘টি’ ব্লক বলেছিল? কেনই বা চিকিৎসকরা নাবালিকাকে মৃত বলে ঘোষণা করার পরেই তড়িঘড়ি হাসপাতাল থেকে চলে এসেছিলেন পরিবারের সদস্যরা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছে পুলিশ। কারণ ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও নাবালিকার দেহে কিছু অস্বাভাবিকতা সামনে এসেছে। তাই এখনই ওই মৃত্যু স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছেন না খোদ অটোপ্সি সার্জেন।
ঘটনার সূত্রপাত গত শুক্রবার। বিকেল ৪টে নাগাদ ১০ বছরের বালিকাকে নিয়ে বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছন তাঁর মা এবং মায়ের এক বন্ধু। চিকিৎসকরা ৪টে ২০ মিনিটে ওই বালিকাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তারপরেই আচমকা বেপাত্তা হয়ে যান নাবালিকার সঙ্গে থাকা আত্মীয়রা। জরুরি বিভাগে লেখানো ফোন নম্বর ধরে ফোন করলে প্রথমে সেই ফোন কেউ ধরেনি বলে জানা গিয়েছে তদন্তে। বেশ খানিক পরে ফের ফোন করা হলে ফোন ধরেন নাবালিকার দাদু। এর মধ্যে নিউ আলিপুর থানার মাধ্যমে হাসপাতালে প্রথমে লেখানো ঠিকানা যাচাই করতে গিয়ে সেই ঠিকানা ভুল বলে জানতে পারেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারণ নিউআলিপুরে ‘টি’ বলে কোনও ব্লক নেই। পরে দাদুকে ফোন ধরলে তিনি সঠিক ঠিকানা দেন। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের মনে সন্দেহ হয় নাবালিকার মৃত্যুর কারণ নিয়ে। তিনি ময়না তদন্তের সুপারিশ করেন। যদিও পরিবারের সদস্যরা ময়নাতদন্ত না করানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন বলেও জানা গিয়েছে তদন্তে।
আরও পড়ুন: বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ছেলের, থানায় অভিযোগ জানালেন শুভ্রজিতের মা
পুলিশ সূত্রে খবর, নিউ আলিপুরের ‘ই’ ব্লকের ওই তিনতলা বাড়িতে নীচের তলায় থাকেন ভাড়াটেরা। বাকি দুই তলায় থাকেন ওই নাবালিকার পরিবার। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, নাবালিকার মা একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। বছর পাঁচেক আগে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি মেয়েকে নিয়ে নিউ আলিপুরের ওই বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। ওই বাড়িটি নাবালিকার মায়ের পিসির। ওই বাড়িতেই মৃতার দাদু-দিদাও থাকেন।
আরও পড়ুন: নিউ আলিপুরে নাবালিকার রহস্যমৃত্যু, পরিবারের আচরণে ‘অসঙ্গতি’
তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছেন, শুক্রবার সাড়ে ৩টে নাগাদ তাঁদের নাতনি প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে ছিল ঘরে। মৃতার মা জানিয়েছেন, তার কয়েক দিন আগে থেকেই মেয়ে পেটের অসুখে ভুগছিল। ফলে শরীর খুব দুর্বল ছিল। প্রায় অচেতন দেখে সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রথমে বেহালার বালানন্দ ব্রহ্মচারি হাসপাতাল এবং সেখান থেকে রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে রেফার করে দেওয়ায় মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হয় বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। তদন্তকারীরা ওই দুই হাসপাতালে তদন্ত করে দেখছেন মৃতার মায়ের ওই বয়ান কতটা ঠিক।
মৃতার মা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে প্রায়ই ভয় পেত। বিভিন্ন বিষয়ে ভয় পেত। মূলত ভূতের ভয়। কিন্তু তার সঙ্গে নাবালিকার মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক খুঁজে পায় নি পুলিশ। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, বিবাহ বিচ্ছেদের পর গত দু’বছর ধরে স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে মৃতার মায়ের। সেই যুবকের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল মৃতার বাড়িতে। ওই শুক্রবার মৃতার মায়ের ওই বন্ধুও ছিলেন হাসপাতালে যাওয়ার সময়।
পুলিশ সূত্রে খবর, ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অমীমাংসিত। নাবালিকার গলায় একটি দাগ পাওয়া গিয়েছে যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অটোপ্সি সার্জেন। চিকিৎসার পরিভাষায় ‘সফ্ট লিগেচার মার্ক’, যা শ্বাসরোধ করে হত্যার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু চিকিৎসক নিশ্চিত হতে পারছেন না কারণ, শ্বাসরোধ করে হত্যা করলে বাকি যা যা চিহ্ন থাকে দেহে, সেগুলি অনুপস্থিত। সেই কারণে তিনি নিজে ঘটনাস্থল অর্থাৎ নাবালিকার বাড়ি এবং সেই ঘর পরিদর্শন করতে চান পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য। কারণ এখনও মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট নয়।
রবিবার ঘটনাস্থলে যান কলকাতা গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকরা। অন্য দিকে নাবালিকার পরিবারের সদস্য এবং ওই বন্ধুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্রে খবর, হাসপাতালে ভুল ঠিকানা দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে পরিবারের সদস্যরা। অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভুল ঠিকানা লেখা হয়েছিল না পরিকল্পনা করেই ভুল ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কেন তাঁরা তড়িঘড়ি হাসপাতাল থেকে চলে এলেন মৃতার দেহ রেখে তা-ও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে দানা বেঁধেছে রহস্য। তদন্তকারীদের ইঙ্গিত, মৃত্যুর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে কোনও রহস্য। তাঁদের আশঙ্কা, পরিবার কিছু তথ্য গোপন করছে।