সম্পত্তি করের হার কমিয়ে শহরবাসীদের সুবিধা দিতে চাইছে কলকাতা পুরসভা। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এতে পুরসভার আয় কিছুটা কমলেও নাগরিকদের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত। শুক্রবার মেয়র পরিষদের বৈঠকে কর নির্ধারণের সংশোধিত পদ্ধতি অনুমোদন করা হয়েছে। এখন থেকেই তা কার্যকর হবে।
ফ্ল্যাট বা বাড়ির ক্ষেত্রে যে সব অংশ সাধারণ বাসস্থান হিসেবে গণ্য নয়, এত দিন তার জন্যও সম-হারে কর দিতে হতো। অর্থাৎ, কোনও বাড়ি বা ফ্ল্যাটের সিঁড়ি, লিফ্ট, বাগান, জিম, আউটহাউস বা অন্যান্য খোলা অংশ একসঙ্গে ধরে নিয়েই ফ্ল্যাট বা বাড়ির কর নির্ধারিত হতো। পুরসভা সূত্রে খবর, সংশোধিত ব্যবস্থায় এখন ফ্ল্যাটের মালিক তাঁর বরাদ্দের যে অংশটি ব্যবহার করেন (বিল্ট-আপ এরিয়া), শুধুমাত্র সেই অংশের জন্য কর নির্ধারিত হবে এলাকায় চালু পুর-করের হিসেবে। কিন্তু সিঁড়ি, লিফ্ট বা বাগানের মতো যে অংশ তাঁর একক ব্যবহারের আওতায় পড়ে না, তার জন্য কর দিতে হবে ফ্ল্যাটের ব্যবহৃত অংশের করের অর্ধেক হারে। সেই কর বহুতলের সব ফ্ল্যাট-মালিকদের মধ্যে ভাগ হবে। মেয়র জানান, নিজস্ব বসত-বাড়ির ক্ষেত্রেও সাধারণের ব্যবহারের অংশের (যেমন সিঁড়ি, বাগান) ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য হবে।
গ্রামে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করার পরে দ্বিতীয় দফায় তৃণমূল সরকার শহরে রাজনৈতিক অবস্থান আরও মজবুত করতে চায়। কর সংশোধনের এই সিদ্ধান্ত তারই একটি ধাপ বলে মনে করছেন অনেকেই। মেয়রের অবশ্য দাবি, এর সঙ্গে রাজনীতির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কর-হারে দীর্ঘদিন একটা অনিয়ম চলছিল। আমরা মনে করেছি সেটা এখনই পাল্টানো দরকার। আগে হয়নি, এখন করলাম। এটা একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।’’
নতুন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শোভনবাবু জানান, বর্তমান কর নির্ধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী— যে সব বড় বহুতল আবাসনে জিম, সুইমিং পুল, খেলার মাঠ রয়েছে, চলতি নিয়মে সেখানকার বাসিন্দাদের অকারণে অনেক বেশি টাকা কর দিতে হয়। তিনি বলেন, এর কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ, সাধারণ জীবনযাপনের জন্য খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, জিমের প্রয়োজন। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে— বড় বহুতলে থাকা জিম, খেলার মাঠ সুইমিং পুলের করও হবে এলাকায় সাধারণ পুর-করের হিসেবে।
পুরসভার এক কর্তা বলেন, সাধারণ ভাবে কেউ প্রোমোটারের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনলে দলিলে ফ্ল্যাটের মোট আয়তন ধরা হয় সাধারণের ব্যবহার্য অংশটি যোগ করে। যাকে বলা হয় সুপার বিল্ট এরিয়া। যে অংশটি আসলে ফ্ল্যাটের মালিক নিজের ব্যবহার্য এলাকার অংশ হিসেবে পান না। অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে এ-ও দেখা যায়, সেই অংশের বেশ কিছুটা পরিমাণের অস্তিত্বই নেই। কলকাতায় এই হিসেব ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ধরা হয়। পুরসভার চলতি কর নির্ধারণের নিয়ম অনুযায়ী, দলিলে ফ্ল্যাটের আয়তন যত বর্গফুট দেখানো হয় এবং তার দাম যত দেখানো হয়, তার ভিত্তিতেই করের পরিমাণ নির্ধারিত হয়।
উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক— কোনও বড় বহুতল আবাসনে কারও দলিলে দেখানো হয়েছে, তার ফ্ল্যাটটি ৫০০০ বর্গফুটের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নিজস্ব ব্যবহারের জন্য পাচ্ছেন সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুট। বাকিটা আবাসনের সকলের ব্যবহারের জন্য। কিন্তু ওই সাধারণের ব্যবহার্য এলাকারও কর বর্তমান পদ্ধতিতে দিতে হয় প্রতিটি ফ্ল্যাটের মালিককে। যা কাম্য নয় বলেই মনে করেন মেয়র। নতুন নিয়মে সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুটের জন্য তাঁকে কর দিতে হবে এলাকায় চালু পুর-করের হারে। তার অর্ধেক হারে কর ভাগাভাগি করে দিতে হবে বাকি অংশের জন্য। যাকে বলে ‘প্রোপোরশনাল কমন এরিয়া’।
কিন্তু ফ্ল্যাটের মালিক আসলে কতটা অংশ নিজের ব্যবহারের জন্য পেয়েছেন, তা নির্ধারিত হবে কী করে?
নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে তিনটি প্রক্রিয়ার কথা— ক) সংশ্লিষ্ট ফ্ল্যাটের পুরসভা অনুমোদিত নকশা।
খ) পুরসভার নথিভুক্ত কোনও এলবিএস-এর দেওয়া শংসাপত্র, প্রোটারের দেওয়া তথ্য, সরেজমিন মাপ করা হিসেবের ভিত্তিতে।
গ) বড় বহুতল আবাসনের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের মালিক বা যিনি পুরকর দেওয়ায় দায়বদ্ধ, তাঁর দেওয়া শংসাপত্র। তবে পুরসভার নথিভুক্ত কোনও এলবিএস বা সরকারি নথিভুক্ত স্থপতির কাছ থেকে সেই শংসাপত্র নিতে হবে।
এই তিনটি পদ্ধতিতে পাওয়া হিসেবে পুরসভা সন্তুষ্ট না হলে, পুর-কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সরেজমিন পরিমাপের ব্যবস্থা করতে পারেন। ফ্ল্যাটের মালিকের ব্যবহার্য অংশ নিশ্চিত হলে তবেই নতুন পদ্ধতিতে কর ধার্য করা হবে বলে পুরকর্তারা জানিয়েছেন।