ডিসেম্বর, ২০২০ সাল। বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন হয়ে মানবশরীরে প্রবেশ করে করোনা প্রজাতির অচেনা ভাইরাস। প্রতীকী চিত্র।
কালো ১
১৩৪৭ সালের অক্টোবর। মধ্য এশিয়া থেকে ইউরোপে পৌঁছয়একটি জাহাজ। নিয়ে আসে বেশকিছু ইঁদুর এবং বিউবোনিক প্লেগ (বগল বা কুঁচকির লসিকাগ্রন্থিফুলে ওঠে যে প্লেগে)। পরবর্তী পাঁচ বছরে ইউরোপে আড়াই কোটি মানুষের ‘কালো মৃত্যু’ হয়। বন্ধ হয়ে যায় সব!
সাদা ১
এই কালো মৃত্যুর দিনগুলোই আনে দিন বদলের স্লোগান। শেষ হয় ইউরোপের সামন্তবাদ। মানুষ বুঝতে পারেন, ভগবানের রোষে নয়, কোনও এক অজানা জীবাণুই হাহাকারের কারণ। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মানাই এর থেকে বেরোনোর পথ। শ্রমিকের শ্রমের কদর আর চার্চের ক্ষমতার হ্রাস ঘটে এর ঠিক পরেই। ঘটে যায় এক বিপ্লব। যার নাম রেনেসাঁ, অর্থাৎ, নবজাগরণ।
কালো ২
১৬০৩ থেকে ১৬১০ সাল। লন্ডন শহরের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ’-এ মৃত্যু হয় শতকরা পঁচিশ ভাগ মানুষের। স্তব্ধ হয়ে যায় লন্ডন শহর। বন্ধ হয় শেক্সপিয়রের সাধের থিয়েটার হল এবং নট্ট কোম্পানি ‘কিং’স মেন’। প্লেগের শ্লাঘা ধরা পড়ে তাঁর লেখনীতে। তিনি শরীরী মৃত্যুর বদলে আত্মার মৃত্যুকেই বেছে নিলেন তাঁর কলমে।
সাদা ২
লন্ডনের সেই ‘কালো মৃত্যু’র দিনগুলোতেই লিখলেন তাঁর কালজয়ী সাহিত্য। রচিত হল ‘কিং লিয়র’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা’র মতো নাটক। আরও এক বার কালোর বাঁধন ছিঁড়ে সাদা ছুঁয়ে গেল মানব ও সমাজের হৃৎস্পন্দনকে।
কালো ৩
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর। হিটলারের ফ্যাসিস্ট শক্তি আক্রমণ হানল পোল্যান্ডে। সূচনা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। পরবর্তী পাঁচ বছর শুধুই মৃত্যু-মিছিল। মৃতের আনুমানিক সংখ্যা ৭ থেকে ৯ কোটি। সেই যুদ্ধের শেষ হয় আরও এক মারণাস্ত্রের ব্যবহারে।
সাদা ৩
যুদ্ধের সেই ছাই থেকে জেগে ওঠে নতুন সভ্যতা আর জীবনের জয়গান। ‘নাইট্রোজেন মাস্টার্ড’ (বোমা তৈরির সামগ্রী) থেকে আবিষ্কার হয় ক্যানসারের কেমোথেরাপি। আধুনিক পৃথিবীর অধিকাংশ উদ্ভাবন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে গিয়েই। ধ্বংস হয় ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা। তৈরি হয় ‘নিউরেমবার্গ কোড’। যা আজও আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার পথপ্রদর্শক। রচিত হয় আরও সাহিত্য। তৈরি হয় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার মানসিক দৃঢ়তা।
কালো ৪
ডিসেম্বর, ২০২০ সাল। বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন হয়ে মানবশরীরে প্রবেশ করে করোনা প্রজাতির অচেনা ভাইরাস। অক্সিজেনের হাহাকার আর মৃত্যু-মিছিল গুঁড়িয়ে দেয় প্রযুক্তি-নির্ভর মানবসভ্যতার দম্ভ। স্তব্ধ হয় জীবন। প্রতি মুহূর্তে শুধুই অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনে ভেসে আসে মরণের বার্তা। কিন্তু সংক্রমণের এই ঢেউ আমরা ১৩৫০ সালের রোমে, ১৬০৭ সালের লন্ডনে এবং ১৯৪১-এর পার্ল হারবারেও দেখেছি। ডাইনোসর পারেনি। মানবজাতির ‘মগজাস্ত্র’ বার বার পেরেছে। সেই রুখে দাঁড়ানোয় অস্ত্র করা হয়েছে বিজ্ঞানকে।
সাদা ৪
তবে কি শোনা যায় নবজাগরণের পদধ্বনি!
কৃষক লালন মিয়াঁ লালারস পরীক্ষা করিয়ে বাড়ি ফিরে বলছেন, ‘‘আরটিপিসিআর নেগেটিভ।’’ সোনালি মাসিমা পাল্স অক্সিমিটার লাগিয়ে ভলান্টিয়ারকে ফোন করে বলছেন, “স্যাচুরেশন ৯৬%, আমি ভাল আছি।’’ উত্তর কলকাতার একটি পাড়ার ক্লাবের সবাই অঙ্গীকার করেছেন, তাঁরা মাস্ক পরে আমপানে বিধ্বস্ত সুন্দরবনবাসীর জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যাবেন। যা বিজ্ঞান আর মানবতার অপূর্ব এক বন্ধন। ‘আমরা করব জয় এক দিন...।’
আশি পেরোনো সালকিয়ার ঠাকুরমা হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিয়ো কলে কথা বলছেন নিউ জার্সিতেথাকা নাতনির সঙ্গে। ‘‘ভাল আছি। দাদুর ভ্যাকসিন হয়ে গেছে। চিন্তা করিস না।’’
কালো সরে যাচ্ছে। সাদার উজ্জ্বল দ্যুতি জানলা দিয়ে বাড়ির মেঝেয় পড়েছে। ঢেউ নিয়ে আর চিন্তা নেই। কারণ, আমরা আবারও পেরেছি। মধ্যরাতেই নতুন দিন আর বছরের সূচনা হয়। তাই রাতের ‘কালো’র মধ্যেই রয়েছে নবজাগরণের ইঙ্গিত।