ঘরে-ঘরে আগেই বসেছিল। এ বার ঠান্ডা হবে লালবাজারের মূল ভবনের বারান্দাও! অর্থাৎ যে বাড়িতে পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্ম কমিশনারদের মতো তাবড় কর্তারা বসেন, সেটি পুরোপুরি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত করার বন্দোবস্ত হচ্ছে। তার ফলে ঘর থেকে বারান্দা পেরিয়ে লিফ্টে উঠতেও গরমের আঁচ পাবেন না শীর্ষকর্তারা।
এ নিয়ে বিশেষ মুখ খুলছেন না কেউই। তবে ব্যাপারটা যে ঘটছে, ঘনিষ্ঠ মহলে তা মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। কলকাতা পুলিশের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা এক কর্তা বলেন, ‘‘পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে। বাস্তবায়ন শুরু হবে। পুরোটা করতে প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ হবে।’’
প্রশ্ন উঠেছে, কলকাতা পুলিশের পরিকাঠামো নিয়ে অভাব-অভিযোগ কম নেই। বহু ক্ষেত্রে নিচুতলার পুলিশকর্মীরা ন্যূনতম সুবিধাটুকুও পান না। সেখানে এত খরচ করে ‘সাহেব’দের বারান্দা ঠান্ডা করার অর্থ কী?
পুলিশের একাংশই বলছেন, শহরে বহু থানায় অনেক সময়েই একাধিক ঘটনা একসঙ্গে ঘটলে বাহিনী পাঠানোর গাড়ি থাকে না। ওসি-র ব্যক্তিগত গাড়িতে বাহিনী যাচ্ছে, এমন দৃশ্যও বিরল নয়। মধ্য কলকাতার একটি থানার অফিসার বলছেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় অপরাধী ধরতে যেতে একটি এসইউভি প্রয়োজন ছিল। গাঁটের কড়ি খরচা করে তা ভাড়া করতে হয়।
লালবাজারের মূল ভবন এসি করার খবর শুনে প্রায় আকাশ থেকে পড়েছেন বেহালা ডিভিশনের একটি থানার ওসি। বলছেন, ‘‘তিন কোটি টাকা খরচ করে এই ব্যবস্থা? আমার থানায় তো চোরের পিছু নিতে একটা ভাল মোটরবাইকও নেই!’’ খাস কলকাতায় এমন অনেক ইনস্পেক্টর রয়েছেন, যাঁদের বয়স আর থানার গাড়ির বয়স প্রায় সমান! তেমনই এক জনের কথায়, ‘‘আমার গাড়ি তো চলে কম, গর্জায় বেশি।’’
ওসি-অতিরিক্ত ওসিরা তবুও ঘরে বাতানুকূল যন্ত্র পান। কিন্তু সাব-ইনস্পেক্টর, কনস্টেবল পদের বহু অফিসার-কর্মী এই প্রকল্পের কথা শুনেই অবাক। কলকাতা পুলিশে দীর্ঘ দিন কাজ করা এক কনস্টেবল বলছেন, ‘‘আমাদের ব্যারাকে থাকাই দায়। গরমকালে রাতেও গায়ে জ্বালা ধরে যায়।’’ দক্ষিণ শহরতলিতেও অনেক থানায় পানীয় জলের জোগানও নিয়মিত নয়! উত্তর কলকাতার এক সাব-ইনস্পেক্টর বলেন, ‘‘রাত পর্যন্ত ডিউটি থাকলে দু’ঘণ্টা হলেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে বাড়ি যেতে হয়। থানায় শোয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই।’’
খাস লালবাজারেরই অন্দরে অন্য বাড়িগুলোরও হালও তো তথৈবচ। গোয়েন্দা বিভাগের অনেক ঘরেই পুরনো দিনের পাখা। গরমে শরীর জুড়োতে ‘বড় সাহেবের’ ঘরে ঘনঘন ফাইল হাতে দৌড়ন অধস্তনেরা। গোয়েন্দা বিভাগের চারতলায় এক পুলিশকর্তার ঘরে বছরখানেক আগে এসি বসেছে। তার আগে ভরা গরমে ওই ঘরে ঢুকতে ‘সাহস’ করতেন না দুঁদে গোয়েন্দারা অনেকেই। ওই বাড়িরই এক বিভাগে প্লাইউডের দেওয়াল কেটে এসির হাওয়া ভাগ করে নেন অফিসারেরা। দোতলার একটি দফতরে বছর কয়েক আগেও ঘুপচি ভাব ছিল। ইদানীং ‘শ্রী’ সামান্য ফিরলেও টেবিল ফ্যানেই সুখী থাকেন অফিসারেরা। মধ্য ডিভিশনের এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনারের ঘরে এসির আওয়াজে চমকে ওঠেননি, এমন দর্শনার্থী খুব কমই আছেন।
তা হলে বারান্দা এসি করা নিয়ে এত চিন্তা কেন?
লালবাজারের অন্দরমহলই বলছে, ‘‘বোধহয় সমালোচনার আঁচ এড়াতে!’’