অকুস্থল: পার্ক সার্কাস এবং শিয়ালদহ স্টেশনের মাঝে এই মতিঝিল এলাকাতেই বারবার ঘটেছে নানা অনভিপ্রেত ঘটনা। নিজস্ব চিত্র
প্রত্যেকেরই বয়স তিরিশের কাছাকাছি। দিন-রাত কাটে নেশার ঘোরেই। মাদক কিংবা মদের নেশার টাকা জোগাড় করতেই প্রয়োজন হয় ছিনতাই করার। এক বার নেশায় বুঁদ হয়ে গেলে তখন আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না নিজের উপরেই। নেশার ঘোরে তখন নিয়ন্ত্রণহীন হাত চলন্ত ট্রেন লক্ষ্য করে ছুড়ে দেয় পাথর, রং-জল ভরা বেলুন, মূত্র ভর্তি পলিব্যাগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিশানা করা হয় লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরাকে। এর পিছনে এক দিকে যেমন বিনোদন রয়েছে, তেমনই হামলাকারীরা এটাও জানে যে, মহিলা কামরা থেকে প্রত্যাঘাত আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
সোমবার, দোলের সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাসে কে বা কারা ডায়মন্ড হারবারগামী লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরা লক্ষ্য করে মূত্র ভর্তি পলিব্যাগ ছুড়েছিল। ঘটনার তদন্তে নেমে রেল পুলিশ ১০-১২ জনের একটি দলকে আটক করে। কিন্তু তারাই ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছেও। কারণ রেল পুলিশের দাবি, ওই তরুণী স্পষ্ট করে অন্ধকারে কাউকে দেখতে পাননি। তবে আটকদের জেরা করে ওই ঘটনায় কারা জড়িত, তা জানার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানান রেল পুলিশ সুপার বন্দনা বরুণ চন্দ্রশেখর।
পুলিশ জানাচ্ছে, মহিলা কামরা লক্ষ্য করে কিছু ছোড়া মনোরঞ্জনের বিষয় বলে আটকদের কেউ কেউ জানিয়েছে। রেল পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, শিয়ালদহ থেকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনের দু’পাশে দারাপাড়া, মতিঝিল-সহ কয়েকটি বস্তি রয়েছে। তার মধ্যে দারাপাড়া এলাকায় চোলাইয়ের দু’টি ঠেক রয়েছে। বিকেলের পর থেকে রমরমিয়ে ঠেক শুরু হয়। ফলে সেখান থেকে এই ধরনের পাথর, বেলুন কিংবা নোংরা ভর্তি পলিথিন উড়ে আসার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। পার্ক সার্কাস স্টেশন সংলগ্ন এলাকা থেকেই পুলিশ দোলের দিনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ওই দলটিকে আটক করে। ওই দলের অনেকেই নেশার ঘোরে ট্রেনের কামরা, বিশেষত মহিলা কামরা লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে বলে সন্দেহ পুলিশের।
তবে শুধুই মহিলা কামরা লক্ষ্য করে পাথর বা নোংরা ছুড়ে আনন্দ লাভ নয়। অভিযোগ, টাকার দরকারে অনেকেই সন্ধ্যার পরে প্রায় খালি মহিলা কামরায় উঠে মোবাইল বা ব্যাগ ছিনতাই করে। কেউ বাধা দিলে তাঁকে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলার অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।
মনোরোগ চিকিৎসক প্রথমা চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে মাদকের নেশা অনেকেরই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। ফলে তাদের স্বাভাবিক গঠন, অনুভূতিগুলির পরিবর্তন হয়, ব্যক্তিত্বও পাল্টে যায়। নেশার ঘোরে রাগ হলে এরা নিশানা করে নিজেদের চেয়ে দুর্বলদের। এরা মনে করে, মহিলারা এদের চেয়ে দুর্বল। এই ধরনের লোকজন কিন্তু সাধারণত নিজেদের চেয়ে শক্তিশালী কারও সঙ্গে গোলমালে জড়ায় না।’’ মনোবিদেরা মনে করেন, ওই তরুণদের ধারণা মহিলা কামরা মানেই সেখানে দুর্বল শ্রেণির লোকজন রয়েছেন। তাই সেখানেই এ ধরনের নোংরা বা পাথর ছুড়ে নিজের রাগ বা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় বলেই তাঁরা মনে করেন।
সরস্বতী পুজোর দিন পার্ক সার্কাস স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পরেই রানাঘাটের এক তরুণীকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। ওই দিনই সোনারপুর থেকে শিয়ালদহ ফিরছিলেন এক তরুণী ও তাঁর মা। ট্রেন পার্ক সার্কাস স্টেশন ছাড়া মাত্রই কয়েক জন যুবক মহিলা কামরায় উঠে তাঁদের ব্যাগ কেড়ে নিতে যায়। তরুণী ব্যাগ চেপে ধরলে তাঁর মুখ লক্ষ্য করে ঘুষি মারে দুষ্কৃতীরা। তাঁর ব্যাগ কাড়তে না পারলেও তাঁর এবং তাঁর মা-সহ আরও দু’জনের মোবাইল নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পালায় ওই যুবকেরা। সরস্বতী পুজোর দিন আক্রান্ত রানাঘাটের ওই তরুণীর কথায়, ‘‘কখন কী উড়ে আসে বা যদি ছিনতাইকারীরা উঠে পড়ে, এই ভেবে সন্ধ্যায় ওই লাইনের ট্রেনে উঠতে আতঙ্ক হয়।’’