উদ্ধার: আগুন লাগার পরে অসুস্থ শিশুকে বার করে আনছেন সিভিক ভলান্টিয়ার। বুধবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
সকাল সাড়ে ৬টা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমসিএইচ বিল্ডিংয়ে একতলার মেডিসিন বিভাগে মেঝেয় শোয়া রোগীদের একাংশের দাবি, ঘরের মেঝে তখনই তেতে গিয়েছে। এরপরেই বেসমেন্টের ওষুধের স্টোর থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে চিৎকার শুরু করেন রোগীর পরিজনেরা!
রোগীদের মধ্যে বুধবার ভোর সাড়ে ৬টায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও দমকলের ডিজি জগমোহন অবশ্য জানিয়েছেন, সকাল পৌনে ৮টায় খবর পান তাঁরা। ১০টি ইঞ্জিন মেডিক্যাল কলেজে যায়। চার ঘণ্টার চেষ্টায় নেভানো যায় আগুন। তত ক্ষণে পুড়ে খাক শতাব্দীপ্রাচীন হাসপাতালের ওষুধের মূল ভাণ্ডার। ধোঁয়ার মধ্যে কোলে করে, কাপড়ে জড়িয়ে, স্ট্রেচারে বা হাঁটিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্তত ৩৫০ জন রোগীকে। জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেকেরই ঠাঁই হয় হাসপাতাল চত্বরে। সেখানে তখন সাত বছর আগের আমরি–আতঙ্ক।
ভিড়ের চাপে সইদুল ইসলাম মল্লিক নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবার মৌখিক দাবি করলেও কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি। রোগীর মৃত্যুর খবর জানালেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, অসুস্থতার কারণেই এই মৃত্যু।
দমকলের প্রাথমিক অনুমান, ওষুধের স্টোরের ফ্রিজারে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে। সেখানে রাসায়নিক, তুলো, গজ-ব্যান্ডেজ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের তৎপরতায় সময়মতো রোগীদের নামিয়ে আনা না গেলে বিপর্যয় ঘটত। প্রশ্ন উঠেছে, রোগীরা ধোঁয়া দেখে সতর্ক করার পর দমকলে দেরিতে খবর গেল কেন? স্টোরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সেভাবে কাজ করল না কেন?
মেডিক্যালে অগ্নিকাণ্ড
কোথায়, কখন
• কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমসিএইচ ভবনের বেসমেন্টে, ওষুধের স্টোরে
• রোগীদের পরিবারের দাবি, সকাল সাড়ে ৬টায় ধোঁয়া দেখতে পান। দমকল ৭টা ৪৫ মিনিটে খবর পায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ৭টা ৫০ মিনিটে ধোঁয়া দেখা যায়
কী ভাবে
• দমকলের প্রাথমিক অনুমান, স্টোরের ফ্রিজারে শর্ট সার্কিট। হাসপাতালের ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি, অন্তর্ঘাত
কত ওষুধ ছিল
• আনুমানিক ৭ কোটি টাকার
কত জন রোগীকে সরানো হল
• মেডিসিন, কার্ডিয়োলজি আর হেমাটোলজির আনুমানিক ৩৫০ জনকে প্রথমে জরুরি এবং বহির্বিভাগে রাখা হয়। তার পর নিয়ে যাওয়া হয় সাইকায়াট্রি, চেস্ট, নতুন মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার হাব-এ
ওই ভবনে কোন কোন বিভাগ
• বেসমেন্টে ফার্মাসি। একতলায় মেডিসিন, কার্ডিয়োলজি, আইসিইউ, দোতলায় মেডিসিন, তেতলায় হেমাটোলজি
• কবে খুলবে
তিন দিনের মধ্যে
পরিষেবায় ব্যাঘাত
বুধবার বহির্বিভাগে সার্ভার বিকল, হাতে লিখেই টিকিট বিলি। বহু রোগী ফিরে গিয়েছেন। ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান চার ঘণ্টা বন্ধ। আজ, বৃহস্পতিবার মেডিসিন, হেমাটোলজিতে রোগী ভর্তিতে নিয়ন্ত্রণ
তদন্ত করবে
• হাসপাতালের কমিটি। দমকল, পূর্ত দফতর রিপোর্ট দেবে ৭ দিনে
রোগী এবং তাঁদের পরিজনদের দাবি, কাকে খবর দিতে হবে, তা খোঁজ করতে করতেই নাকি সময় কেটে যায়। সকাল সাড়ে ৬টায় ধোঁয়া বেরোতে দেখে উপস্থিত পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি) চিকিৎসক এবং হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের জানানো হয়। তাঁরাও পোড়া গন্ধ পান। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা বিষয়টি জানান তাঁদের অফিসারকে। ফার্মাসি বিভাগের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে ধোঁয়া দেখেন তিনিও। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা এর পরে সুপার এবং অধ্যক্ষের অফিসে যান। সেখানে কেউ ছিলেন না। এর পরে পিজিটি-রা সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হাসপাতালের এক কর্তা ডেপুটি সুপার জয়ন্ত সান্যালকে খবর দেন। তিনিই যোগাযোগ করেন দমকল এবং হাসপাতালের অন্য কর্তাদের সঙ্গে। ওয়াজিদ আলি লস্কর নামে এক রোগী বলেন, ‘‘সকালেই বলেছিলাম, এত গরম লাগছে কেন? কিছু পুড়ছে! আয়া দিদি বকতে শুরু করলেন। বললেন, এসি আনব? আর একটু দেরি হলে তো মরেই যেতাম!’’
দেখুন ভিডিয়ো
হাসপাতালের সুপার ইন্দ্রনীল বিশ্বাস অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে ধোঁয়া দেখেই খবর যায় দমকলে। তারপর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রও বলেন, ‘‘রোগী নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হাসপাতালে ছিল।’’ তবে সাতসকালে আগুনের জেরে ব্যাহত হয় পরিষেবা। দুপুর সাড়ে ১২টার আগে বহির্বিভাগ থেকে রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
অগ্নিনির্বাপণে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে সমস্যা হয়েছিল বলে দমকল সূত্রের দাবি। আগুন নেভাতে এই ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’য়ের দেওয়াল এবং একতলার মেঝেতে গর্ত করতে হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘স্টোরে ঢুকতে দমকলের সামান্য সমস্যা হয়েছে। কেন হয়েছিল তা তদন্তে বোঝা যাবে।’’
হাসপাতালের সুপার জানান, এমসিএইচ হাবের চারতলায় ওষুধের অস্থায়ী স্টোর করা হবে। আপাতত ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে সামাল দেওয়া হবে পরিস্থিতি।