সজাগ: দূরত্ব-বিধি মানতে বসার জায়গার মাঝখানে দেওয়া হয়েছে কাচের দেওয়াল। সোমবার, পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তরাঁয়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা বলে একটা কথা আছে! লকডাউনের আগল খোলার আভাস পাওয়া মাত্র সেটাই সোমবারের দুপুরে মুর অ্যাভিনিউয়ের প্রবীণ দম্পতিকে টেনে এনেছিল পার্ক স্ট্রিটে। কয়েক মাস পরে শহরের রাস্তায় শ্বাস নিতে পেরে ফুরফুরে দু’জনে প্রিয় রেস্তরাঁয় মধ্যাহ্নভোজ সারলেন।
বার্বিকিউয়ে নুডলস্, কোনজি ক্রিস্পি চিকেন, চিলি পর্কের অনেকটাই খেতে না-পেরে বাক্সে ভরে নিলেন তাঁরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভদ্রমহিলা বললেন, ‘‘বয়স্কদের বেরোনোয় বারণ রয়েছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে কর্তার অপারেশন হওয়া ইস্তক বাড়ি-বন্দি ছিলাম। পার্ক স্ট্রিটে আজ ওঁর চুল না-কাটালেও চলছিল না। বাইরে খাওয়ার ইচ্ছেটুকুও দু’জনেই প্রশ্রয় দিলাম।’’
কলকাতার সাবেক ফুড স্ট্রিটে ট্রিঙ্কাজ় বা অলি পাবের মতো ঠিকানা এখনও বন্ধ। পাল্টে গিয়েছে অনেক কিছুই। সতর্কতা-বিধি মেনে অর্ধেক টেবিল
খালি। পিটার ক্যাটে আবার টেবিলের মাঝে পুরু কাচের দেওয়াল। রবিবারের বৃষ্টিতে মোক্যাম্বোয় জল ঢুকেছিল। ফলে খুলতে দেরি হয়েছে। মার্কো পোলোয় দেখা গেল ‘টেক অ্যাওয়ে’-রই বেশি চাহিদা। ফ্লুরিজ় সকাল-সকাল খুললেও সেখানে ভিড়টা প্রধানত অফিসযাত্রীদের।
কাজের দিনের দুপুরেও ভিড় থাকে ধর্মতলার আমিনিয়ায়। লকডাউন ও আনলকের সন্ধিপর্বে জনৈক অতিথির ৯৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকায় রেস্তরাঁর কর্মীরা তাঁকে সবিনয়ে বিদায় জানালেন। পার্ক স্ট্রিটে চিনে খানার ঠেক টুং ফঙে ভিতরে ঢুকতেই সুগন্ধী রাসায়নিক ছড়িয়ে অতিথিদের শুদ্ধ করা হল। সেখানে একটি কোড স্ক্যান করলে মেনু কার্ড পৌঁছে যাচ্ছে ফোনে। কেউ নগদ টাকায় দাম মেটালে, তা-ও তখনই জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। সরকারি ফরমানে ৬৫ ঊর্ধ্ব বা ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো আনুষঙ্গিক রোগে ভোগা নরনারীর জন্য না-বেরোনোর পরামর্শ রয়েছে। তবু স্বেচ্ছাবসরপ্রাপ্ত ছেলের পেনশন তুলতে লাঠি ঠুকঠুকিয়ে ধর্মতলায় এসেছেন বাঁশদ্রোণীর শিখা সেনগুপ্ত। পুত্র অনিন্দ্য অসুস্থ, তাই সত্তরোর্ধ্ব মা তাঁর সঙ্গী। আমিনিয়ায় বসে শিখাদেবী বললেন, ‘‘রান্না কখন করব! তাই রুটি ও স্পেশাল মাটন কারি খেয়ে নিচ্ছি। এটা আমার স্বামীরও প্রিয় ছিল।’’
গোলবাড়ি, দিলখুসা কেবিন, প্যারামাউন্ট বা ভবানী দত্ত লেনের উৎকলীয় ভাতের হোটেলের মতো সাবেক দোকান এখনও বন্ধ। অনেক নামী রেস্তরাঁও জল মাপছে। তবু বিকেলে বৃষ্টির পরে দক্ষিণ কলকাতার কফিশপগুলিতে খানিক ভিড় দেখা গেল। গান ও পানের জন্য তরুণদের মনপসন্দ রবীন্দ্র সরোবরের কাছের হোয়াটসঅ্যাপ কাফেয় এখন সুরাপানের সুযোগ নেই। তাতেও বিধি মেনেই রেস্তরাঁ ভরপুর। সন্ধ্যার মুখে লাইভ মিউজ়িকও শুরু হল। অউধ ১৫৯০, চাউম্যানের কর্তাদেরও দাবি, প্রথম দিন ভিড় খারাপ নয়।
আগের দিনপিছু ব্যবসার ৮০ ভাগ হতে শুরু করেছে। বিকেলে পূর্ণ দাস রোডের ওয়াইজ় আউল কাফেয় মাস্ক পরে মুখোমুখি দুই তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের কর্মী। কাছাকাছি দরকারে এসে বহুজাতিক ব্যাঙ্কের কর্মী বিবেক সিংহও কাফেয় বসেই ল্যাপটপে কাজ সারছেন। গোলপার্কে ছবি, বইয়ে সাজানো কাফে ট্রাইব খোলা পেয়ে মিটিং সারতে ঢুকে পড়লেন কলেজশিক্ষিকা রঞ্জিতা রায়চৌধুরী, পুষ্টিবিশারদ সুচন্দ্রা চট্টোপাধ্যায়, ডাক্তার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়রাও। পরে ভাস্করবাবু বলছিলেন, ‘‘সাবধানে
থাকলেও চলাফেরা একেবারে বন্ধ কী ভাবে করব।’’
অর্থনীতির বেহাল দশায় ঝাঁপ বন্ধের মুখে শহরের অনেক রেস্তরাঁ। তবু এই অসময়েও একটু-একটু করে জাগছে সামাজিক কলকাতা।