‘গজমোতি’ বেচতে চেয়ে গারদে সেতার শিক্ষক

সত্যি আছে? প্রবাদ অনুযায়ী, গজমোতি হল হাতির মাথায় তৈরি হওয়া দুর্মূল্য মুক্তো।দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ কিংবা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর মতো নানা রূপকথার গল্পে গজমোতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে হাতির মাথায় মুক্তো তৈরি হয় না।রূপকথার সেই ‘গজমোতি’ এক বার যদি হাতের মুঠোয় এসে যায়, তা হলে খুলে যাবে কপাল! ঘোর কলিতে নেট দুনিয়ায় সেই ‘গজমোতি’র বিজ্ঞাপন দেখে চমকে উঠেছিলেন বন দফতরের কর্তারা।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪১
Share:

ধৃত প্রবাল চৌধুরী।

রূপকথার সেই ‘গজমোতি’ এক বার যদি হাতের মুঠোয় এসে যায়, তা হলে খুলে যাবে কপাল!

Advertisement

ঘোর কলিতে নেট দুনিয়ায় সেই ‘গজমোতি’র বিজ্ঞাপন দেখে চমকে উঠেছিলেন বন দফতরের কর্তারা।

যিনি ওই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তাঁর দাবি ছিল, হাতির মাথার ভিতরে নাকি মুক্তো থাকে! তাঁর কাছে রয়েছে সেই দুর্মূল্য বস্তুটি। রাতারাতি ফকির থেকে রাজা করে দেবে সেই মুক্তো। আর ওই গজমোতি কিনতে হলে চাই মাত্র এক কোটি টাকা।

Advertisement

বিভিন্ন রূপকথার গল্পে যে গজমোতির কথা জানা যায়, সেটা একেবারই কাল্পনিক বস্তু। সেই সব গল্পে বলা হয়, লাখে একটি হাতির মাথায় এমন মুক্তো মেলে। তাই এর ওষধি এবং জাদু ক্ষমতা রয়েছে। সেই কারণেই এই গজমোতি নাকি দুর্মূল্য!

বনকর্তারা জানান, নিজের শরীরে কোনও বালিকণা ঢুকলে তার উপরে দেহরসের আবরণ দিতে থাকে ঝিনুক। সেটাই ধীরে ধীরে মুক্তোর আকার নেয়। হাতির মাথায় মুক্তো তৈরি হওয়ার কারণ নেই। এমন কিছু হয় না।

অথচ বিজ্ঞাপন বলছে, গজমোতি আছে এবং তা খাস কলকাতার ভাবনীপুরের বাসিন্দা প্রবাল চৌধুরীর কাছে রয়েছে। দিন দুই আগে ক্রেতা সেজে তাঁকে ফোন করেন বন দফতরের এক অফিসার। প্রথমে ফোনটি বেজে যায়। পরে সেই নম্বর থেকে তাঁকে ফোন করা হয়। বন দফতরের ওই অফিসার ফোনে বলেন, তিনি তাঁর ভাগ্য ফেরাতে চান। বিজ্ঞাপনে গজমোতির দাম বলা ছিল না। অন্য প্রান্ত থেকে প্রবাল জানান, এক-একটির দাম এক কোটি টাকা!

এর পরেও ওই অফিসারের সঙ্গে বার দুয়েক কথা হয় প্রবালের। তাতেই ঠিক করা হয়, ভবানীপুরের ঠিকানায় বৃহস্পতিবার রাতে গিয়ে প্রবালের কাছ থেকে গজমোতি নেবেন ওই অফিসার। প্রবালের হাতে তুলে দেবেন এক কোটি কড়কড়ে নগদ টাকা।

সেই কথা মতো বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে দু’-তিন জন সহকর্মীকে নিয়ে ভবানীপুরের রূপনারায়ণ নন্দন লেনে হাজির হন ওই অফিসার। হাতে ব্যাগ। নিজের আসল পরিচয় গোপন করে ওই অফিসার প্রবালকে জানান, ওই ব্যাগে টাকা রয়েছে। কিন্তু আগে গজমোতি দেখতে চান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ছোট পোলট্রি ডিমের মাপের একটি পাথর নিয়ে আসেন প্রবাল। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।

এই সেই গজমোতি!

এর পরে তল্লাশি চালিয়ে প্রবালের ঘরে ওই রকম আটটি পাথর পেয়েছেন অফিসারেরা। যা বিক্রি করে আট কোটি টাকা মুনাফার ধান্দায় ছিলেন প্রবাল। সেই পাথরের মধ্যে চারটি সাদা হলেও বাকি চারটি হাল্কা বাদামি রঙের। প্রবালের দাবি, সেগুলি সব হাতির মাথার ভিতরের পাথর। পুরাণে যাকে গজমোতি বলে। বনকর্তারা জানাচ্ছেন, আদতে কী দিয়ে এই পাথর তৈরি, তা পরীক্ষার জন্য ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হবে।

জানা গিয়েছে, প্রবাল পেশায় সেতার শিক্ষক। বনকর্তারা বলছেন, গজমোতির গল্প বলেই ওই পাথর বিক্রির ফন্দি ছিল প্রবালের। ওয়েবসাইটে, ফেসবুকে দেওয়া বিজ্ঞাপনে ওই ‘গজমোতি’র কোনও নির্দিষ্ট দামও বলেননি তিনি। অফিসারদের আশঙ্কা, খুব তাড়াতাড়ি লোক ঠকিয়ে ওই পাথরগুলি চড়া দামে বিক্রি করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।

বন দফতর সূত্রের খবর, পাকড়াও করার পরে প্রবালকে বেশ কয়েক দফা জেরা করেছেন বন্যপ্রাণ শাখার কর্তারা। তাঁদের দাবি, ফাঁদে পড়েছেন বুঝতে পেরেই উল্টোপাল্টা কথা বলতে শুরু করেন প্রবাল। এই ‘মোতি’ এক সাধুর কাছ থেকে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন প্রবাল। কিন্তু সেই সাধু কে? তিনি কোথায় থাকেন? কী ভাবেই বা তাঁর সঙ্গে দেখা হল— এ সবের কোনও স্পষ্ট উত্তর দেননি প্রবাল। এক বনকর্তার দাবি, জেনেশুনেই মানুষ ঠকানোর কাজে নেমেছিলেন ওই ব্যক্তি। ধরা পড়ার পরে এখন না-জানার ভান করছেন।

ওই ‘গজমোতি’ হাতি বা কোনও বন্যপ্রাণীর দেহাংশ কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই বন দফতর প্রবালকে গ্রেফতার করল কী ভাবে? হতেও তো পারে সেগুলি পাথর নয়, সত্যিই হাতি বা কোনও প্রাণীর দেহাংশ। এমন প্রশ্ন করছেন অনেকেই। বনকর্তাদের ব্যাখ্যা, কোনও ব্যক্তি যদি বন্যপ্রাণীর দেহাংশ দাবি করেও কিছু বিক্রির চেষ্টা করে, তা হলেও বন্যপ্রাণ আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই ময়ূর বা অন্য কোনও দেশি পাখির পালক বিক্রেতাকে ধরে দেখা যায়, দেশি পাখির পালকের মধ্যে কিছু মুরগির পালকও মিশে রয়েছে। বন দফতরের এক অফিসার বলছেন, ‘‘প্রবাল যদি গজমোতির নাম করে লোক ঠকিয়ে থাকে, তার তদন্ত পুলিশ করবে। এখনও তেমন কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি।’’

অর্থাৎ, ‘মোতি’ হোক বা নুড়ি, ভাগ্য ফেরানোর ব্যবসা করতে গিয়ে আইনের জালে ভাল ভাবেই জড়িয়েছেন ওই সেতার শিক্ষক। যা নিয়ে বন্যপ্রাণ শাখার এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, ‘‘লোকের ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের ভাগ্যই যে বিগড়ে যাবে, তা বুঝতে পারেননি!’’ পুলিশ জানিয়েছে, শুক্রবার আদালতে তোলা হলে বিচারক অবশ্য প্রবালকে জামিনে মুক্তি দিয়েছেন।

ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement