সে বার তিনি বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। মানুষের প্রত্যাশাও ছিল অনেক। কিন্তু, কয়েক মাস কাটতে না কাটতেই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার স্বর শোনা গিয়েছিল তাঁর গলায়। পার্ক স্ট্রিটের গণধর্ষণের পর সেই ঘটনাকে সাজানো বলে মন্তব্য করেছিলেন তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মন্তব্য প্রভাবিত করেছিল তদন্তকেও। যার ফলে, একটা সময় সরে যেতে হয় কলকাতার গোয়েন্দা প্রধানকেও।
এ বারও তিনি ক্ষমতায় এসেছেন আরও বিপুল জনাদেশ নিয়ে। মানুষের প্রত্যাশা আরও বেশি। শপথ নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সল্টলেকে গাড়ির মধ্যে পার্ক স্ট্রিটের কায়দায় গণধর্ষণের অভিযোগ উঠল। অথচ এ বার কোনও মন্তব্যই করলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে তদন্ত এগোলো নিজের পথে। অভিযোগ ওঠার ২৪ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই গ্রেফতার করা হল তিন জনকে। পুলিশের কাছে তারা কবুলও করে ফেলল অপরাধের কথা। শাসক দলের কর্ত্রী তো বটেই দলের ছোট-মেজো-সেজো-ন’-রাঙা— কোনও নেতাই একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না।
তবে কি পাঁচ বছর পরে মমতা আরও বেশি পরিণত? আরও বেশি অভি়জ্ঞ? নাকি পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন তিনি? রাজনৈতিক শিবিরগুলিতে এ নিয়েই আপাতত চর্চা চলছে। সেই সময় কী হয়েছিল উঠে আসছে সেই আলোচনাও।
২০১২-র সেই রাতে পার্ক স্ট্রিটের একটি হোটেলের সামনে থেকে সুজেট নামে এক মহিলাকে গাড়িতে তোলে পাঁচ যুবক। চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ করে তাঁকে এক্সাইড মোড়ের কাছে ফেলে দেওয়া হয়। তিন দিন পরে পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জানালেও পুলিশ প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। পরে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে লালবাজারের একাংশ।
এই ঘটনার ঠিক এগারো মাস আগেই ৩৪ বছরের বামেদের পালাবদল ঘটিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী তাকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলেছিলেন। রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই ঘটনাটি সাজানো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। সরকারের প্রধান ব্যক্তি এ কথা বলার পরেই কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎ পচনন্দাও একই সুর ধরেন। সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে এই অপপ্রচার করা হচ্ছে।’’ এর পরে একে একে শাসক দলের একাধিক নেতা ‘সাজানো ঘটনা’তেই সায় দেন। অর্পিতা ঘোষ, কাকলি ঘোষদস্তিদার, মদন মিত্র তো আবার সুজেটের চরিত্র নিয়েই প্রকাশ্যে কটাক্ষ করেছিলেন।
যদিও সাজানো ঘটনার তত্ত্ব নস্যাৎ করে তত্কালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনই প্রথম জানিয়েছিলেন, সুজেটকে গণধর্ষণই করা হয়েছে। তাঁর উদ্যোগেই ধরা হয় তিন অভিযুক্তকে। এর পরে দময়ন্তীকে মহাকরণে ডেকে পাঠানো হয়। মু্খ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে থমথমে মুখে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন দময়ন্তী। এর কিছু দিন পরে তিনি বদলি হয়ে যান ব্যারাকপুরের পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। নিন্দুকেরা বলেছিলেন, আসলে মুখ্যমন্ত্রী রুষ্ট হয়েছিলেন ওই পুলিশ অফিসারের উপর। সেই সময় কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) ছিলেন জাভেজ শামিম। দময়ন্তীর সঙ্গে তাঁকেও ডেকে পাঠিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এখন সেই জাভেদ শামিম বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার।
রাতের সল্টলেকে গাড়িতে গণধর্ষণের যে অভিযোগ উঠেছে, তার কয়েক দিন আগেই রাজ্যে ফের ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ, এই ঘটনার পর তিনি বা তাঁর সরকারের কোনও প্রতিনিধি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। সাজানো তো দূরে থাক, ঘটনা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তাঁরা। পুলিশ নিজের মতো করে তদন্ত করেছে। অভিযোগকারিণীর বয়ানের উপর নির্ভর করে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন গোয়েন্দারা। মঙ্গলবার বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার এই ঘটনায় তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতারের খবর জানিয়েছেন। ঘটনাচক্রে দময়ন্তী সেনের সঙ্গে যাঁকে মহাকরণে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সেই সময়কার মুখ্যমন্ত্রী, সেই জাভেদ শামিমই এখন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার।