হকারদের লাইসেন্স-বিমা, ত্রস্ত পুলিশ-দোকানদারেরা

‘অপারেশন সানশাইনের’ প্রায় দু’দশক বাদে শহরের ফুটপাথে বসা হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে ‘হকার ভাই-বোনদের সমর্থনে’ আয়োজিত সভায় (শহর জুড়ে এই ভাষাতেই হোর্ডিং দিয়েছে পুরসভা) মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হকারেরা গরিব। ব্যবসা করলেও বৈধ কিছুই ছিল না। সরকার ওঁদের বৈধ লাইসেন্স দেবে। ব্যবসার অধিকার দেবে। সেই সঙ্গে নামমাত্র টাকায় ওঁদের বিমার সুবিধাও দেবে সরকার।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৫৭
Share:

রবীন্দ্র সরোবরে হকারদের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। ছবি: প্রদীপ আদক।

‘অপারেশন সানশাইনের’ প্রায় দু’দশক বাদে শহরের ফুটপাথে বসা হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে ‘হকার ভাই-বোনদের সমর্থনে’ আয়োজিত সভায় (শহর জুড়ে এই ভাষাতেই হোর্ডিং দিয়েছে পুরসভা) মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হকারেরা গরিব। ব্যবসা করলেও বৈধ কিছুই ছিল না। সরকার ওঁদের বৈধ লাইসেন্স দেবে। ব্যবসার অধিকার দেবে। সেই সঙ্গে নামমাত্র টাকায় ওঁদের বিমার সুবিধাও দেবে সরকার।” ঘোষণা শুনেই সভায় হাজির হকারেরা মুখ্যমন্ত্রীর নামে জয়ধ্বনি করে ওঠেন। বিরোধীদের অভিযোগ, আসন্ন পুরভোটের দিকে তাকিয়ে ট্যাক্সি চালকদের পরে হকারদের প্রতিও কল্পতরু হলেন মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

বাম আমলে ১৯৯৬ সালের এক রাতে ‘অপারেশন সানশাইন’ অভিযান করে গড়িয়াহাট মোড় ও হাতিবাগান এলাকাকে হকারমুক্ত করেছিল কলকাতা পুরসভা। তখনকার বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই অভিযানের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তার পর ধীরে ধীরে ফের ফুটপাথে ফিরে আসতে শুরু করেন হকারেরা। পুরসভার তরফে বারবার তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

এ দিন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে পাশে বসিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য হকাররা কী ভাবে ব্যবসা করবেন তার একটা রূপরেখাও তৈরি করে দেন। তিনি বলেন, “হকারদেরও মনে রাখতে হবে কোনও দোকান ঘিরে বসা যাবে না। রাস্তার উপরে বসা যাবে না। আর পুরো ফুটপাথ দখল না-করে পথচারীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথাও মাথায় রাখতে হবে।”

Advertisement

কিন্তু বাস্তবে এই নির্দেশে কাজ কতটা হবে তা নিয়ে বিরোধীদের যেমন সংশয় রয়েছে, তেমনই আশঙ্কিত পুলিশও। পুলিশ কর্তাদের বক্তব্য, ফুটপাথ হকারদের দখলে চলে যাওয়ার ফলে পথচারী বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে আসবেন। বাড়বে দুর্ঘটনা। এক অফিসারের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী ট্যাক্সিচালকদের রাতে যাত্রী প্রত্যাখ্যান করার অধিকার দিয়ে দেওয়া এবং জরিমানার টাকা এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দেওয়ার পরে এখন আমরা টাক্সিচালকদের সমীহ করে চলছি। এ বার হকারদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। ফুটপাথ দখল করে মানুষকে সমস্যায় ফেললেও আমাদের কিছু করার থাকবে না।”

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

আশঙ্কা দোকানদারদের মধ্যেও। হকারদের জ্বালায় জেরবার হয়ে গত টানা তিন দিন দোকান বন্ধ রেখেছেন নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা। এ দিন তাঁর বক্তৃতায় সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি মুখ্যমন্ত্রী। দোকান মালিকদের আশঙ্কা, মুখ্যমন্ত্রীর যে সব শর্ত দিয়েছেন তা মানা হবে না। ফুটপাথে শুধু হকারই থাকবে। দোকানে ঢুকতে পারবেন না কোনও পথচারী।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি পথচারী এবং দোকানদারদের অসুবিধার প্রসঙ্গ তোলার পাশাপাশি ভোটের রাজনীতির অভিযোগও এনেছে। প্রাক্তন মেয়র সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিজেপি নেতা তথাগত রায়, কংগ্রেসের অরুণাভ ঘোষেরা বলেছেন, করদাতাদের টাকায় দানছত্র খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুরভোটের আগে এটা নির্বাচনী চমক। বিরোধীদের কথায়, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাতেই রয়েছে সবই হবে পুরভোটের পর। দু’তিন দিনের মধ্যেই কলকাতা পুরভোটের বিজ্ঞপ্তি বের হবে। তার আগেই হকারদের পক্ষে টানতে এই তৎপরতা।

এ দিনের সভায় হকারদের কী কী সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে?

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এ দিন পর্যন্ত (শুক্রবার) কলকাতা ও রাজ্যের অন্যত্র যত হকার বসছেন, তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হবে। তাঁর কথায়, “সভা করার আগে পুলিশকে দিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। কোন থানার অধীনে কত হকার রয়েছে তার রেকর্ড রয়েছে সরকারের কাছে। আজ পর্যন্ত যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরই বৈধ লাইসেন্স দেওয়া হবে। আগামী কাল নতুন করে বসলে পাবেন না।” যে কোনও দিন উচ্ছেদ করে দেওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে হকারদের মুক্ত করাই তাঁর সরকারের হকার নীতির লক্ষ্য বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হকারিকে আইনগত অধিকার দিতে চাই। সারা বাংলা জুড়ে সবার জন্য এমন পলিসি নেওয়া হয়েছে, যা দেশে এই প্রথম।”

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সামনে পুরভোট। ভোটের পর জুলাই মাসের ১৫ তারিখ থেকে আপনারা নিজ নিজ এলাকার ব্যবসার জায়গা, নিজের নাম-ধাম দিয়ে সংশ্লিষ্ট পুর প্রশাসনের কাছে জমা দিন। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সের হকারেরা ওই সুযোগ পাবেন। জমা দেওয়ার জন্য তিন মাস পর্যন্ত সময় থাকবে।” তিনি জানান, জমা পড়া দরখাস্ত খতিয়ে দেখতে প্রতিটি পুরসভায় এক জন করে অফিসার নিয়োগ করা হবে। দরখাস্ত খতিয়ে দেখার কাজ শুরু হবে চলতি বছরের শেষে, চলবে ২০১৬-র মার্চ পর্যন্ত। সেই বছর ১৫ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) তিনি নিজে হকারদের হাতে লাইসেন্স দেবেন বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।

সেখানেই শেষ নয়, লাইসেন্সপ্রাপ্ত হকারদের সরকার বিমায় সহায়তাও দেবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “হকারেরা মাত্র এক বার ৩০ টাকা দেবেন সরকারের কাছে। সরকারের একটি স্কিম রয়েছে, তাতে সংশ্লিষ্ট হকার ৬০ বছর বয়স উত্তীর্ণ করলেই এককালীন ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পাবেন। তা ছাড়া ওই সময়ের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হলে ৫০ হাজার টাকা পরিবার পাবে। আর দুর্ঘটনায় মারা গেলে পরিবার পাবে দেড় লক্ষ টাকা।”

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা কী ভাবে কার্যকর যাবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে প্রশাসনিক মহলে। কেউ কেউ যেমন বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তা ঠিক হলে কোনও হকার মাত্র এক বার ৩০ টাকা দিলে, ৬০ বছর পেরোলেই আড়াই লক্ষ টাকা পাবেন। অর্থাৎ কোনও হকারের এখন বয়স ৫৫ হলে তিনি তো লাইসেন্স পাবেন। এবং ৩০ টাকা দিয়ে সরকারি স্কিমের সুযোগও পাবেন। স্বভাবতই মাত্র ৫ বছর পর ৬০ পেরোলেই মিলবে আড়াই লক্ষ টাকা! এটা কী ভাবে সম্ভব!

এ প্রসঙ্গে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “এটা স্রেফ একটা ভাঁওতা। বিপজ্জনক সিদ্ধান্তও।”

বিজেপির তথাগত রায়ের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দানছত্রে পরিণত করেছেন। কিছু পাইয়ে দিয়ে হকারদের ভোট কেনার চেষ্টা।” কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ বলেন, “অবিবাহিত হকারদের জন্য মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে দেওয়াটাই বাকি রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী!”

মঞ্চে মমতা, তবু ফাঁকা সভা

নিজস্ব সংবাদদাতা

বক্তা খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু ভরল না রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের আসন! মুখ্যমন্ত্রীর সভার চেনা পরিচিত ভিড়ে ঠাসা চেহারাটা চোখে পড়ল না শুক্রবার। এ দিন রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে রাজ্য সরকারের হকার নীতি ঘোষণার জন্য হকারদের নিয়ে সভার আয়োজন করে পুর দফতর। স্টেডিয়ামের গ্যালারি তো বটেই, ব্যবস্থা করা হয়েছিল হাজার দু’য়েক অতিরিক্ত চেয়ারেরও। উদ্যোক্তাদের আশা ছিল, অন্তত হাজার পঁচিশেক মানুষ আসবেন-ই। কিন্তু পুলিশের হিসেব বলছে, মাত্র হাজার পাঁচেক মানুষ এসেছিলেন সভায়। অথচ মুখ্যমন্ত্রী নির্দিষ্ট সময়, বেলা দেড়টাতে আসেন সভায়। দু’টো নাগাদ কোনও মতে প্লাস্টিকের চেয়ারগুলি ভরেছে। কিন্তু গ্যালারির বিশাল দর্শকাসন খালি। যে অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী হকারদের ট্রেড লাইসেন্স, বিমা পলিসি-সহ গুচ্ছ সুবিধার কথা ঘোষণা করলেন, সেখানে এমন ধু-ধু অবস্থা কেন? এ দিনের অনুষ্ঠানে লোক আনার দায়িত্বে ছিলেন তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী দোলা সেন। তাঁর অবশ্য দাবি, এত গরম সত্ত্বেও লোক ভালই হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement