ছটপুজো। বুধবার, বাবুঘাটে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
দুর্গা, কালীর পরে এ বার ছটপুজোতেও পুরস্কার!
বুধবার বন্দর এলাকার দইঘাটে গিয়ে এমনই বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতি বছরের মতো ছটপুজোর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ দিন বিকেলে ওই ঘাটে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে পুজোর উদ্যোক্তারা তাঁকে অনুরোধ করেন, দুর্গাপুজো, কালীপুজোর মতো ছটপুজোতেও যেন রাজ্য সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। তা শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি বিষয়টি পুলিশ কমিশনারকে জানিয়ে দেব।”
এ দিন সন্ধ্যায় কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র জানান, ছটপুজোয় পুরস্কার দেবে কলকাতা পুলিশ। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মাপকাঠি তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এই পুরস্কারের মাপকাঠি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, ছটপুজোয় প্রচুর ফুল-ফল গঙ্গায় ফেলা হয়। ফলে দূষণ বাড়ে। এমনিতেই এ রাজ্যে গঙ্গার দূষণ অতিরিক্ত মাত্রায় বেশি।
নদী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, নদীর দূষণ মাপা হয় তার জলে ‘ফিক্যাল কলিফর্ম’ নামে একটি ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ দেখে। নদীর জলে টাইফয়েড বা অন্যান্য জটিল রোগের জীবাণু বাড়ছে কি না, তা বুঝতে গেলে ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রাই বিচার করেন বিজ্ঞানীরা। কেন্দ্রীয় পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, এ রাজ্যে কোথাও গঙ্গায় ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রা স্বাভাবিকের পাঁচ গুণ, কোথাও বা তার চেয়েও বেশি। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইনি অফিসার বিশ্বজিত্ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “এই পরিস্থিতিতে ছটপুজোয় পুরস্কার দিতে গেলে পরিবেশ আইনের মাপকাঠি রাখতেই হবে।”
বিশ্বজিত্বাবু বলছেন, দুর্গাপুজোর বিসর্জনে গঙ্গায় ফুল-মালা ফেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ বার ছটপুজোতেও তা করা উচিত। “কমিটিগুলি যদি এই ব্যবস্থা করতে পারে, তা হলে পুরস্কারের গুরুত্ব রয়েছে।”বলছেন বিশ্বজিত্বাবু। কিন্তু এটা করা কি আদৌ সম্ভব?
বন্দর এলাকার তৃণমূল নেতা রামপেয়ারি রাম বলছেন, ছটপুজোয় গঙ্গায় ফুল-ফল ফেলাটা মোটেই বাধ্যতামূলক নয়। ফলে গঙ্গা দূষণ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। কিন্তু ছটপুজোর ভিড়ে এ ভাবে ফুল-ফল ফেলার উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।
যেমন আরও একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। কী সেই প্রশ্ন?
অনেকেই বলছেন, গত লোকসভা ভোট থেকেই রাজ্যে বিজেপির প্রভাব বেড়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নিজের এলাকায় বহু ওয়ার্ডে হেরেছে তৃণমূল। তার উপরে অবাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাই কলকাতা পুরভোটের দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সেই ভোট নিজের দিকে কাড়ার চেষ্টা করছেন কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে।
বস্তুত, ছটপুজোয় কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে বিজেপিও। এ দিন বিকেল থেকেই উত্তর কলকাতার জোড়াবাগানে নিমতলা ঘাটের দিকে ছটপুজোয় যাওয়া লোকজনকে জল-সরবত খাওয়ানোর শিবির খুলেছিলেন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি নেতা নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। বিজেপির চা-জল-সরবতের শিবির খোলা হয়েছিল শোভাবাজার-সহ উত্তর কলকাতার আরও কয়েকটি পাড়ায়। কোথাও দল বেঁধে সরবত খেতে ভিড় করেছেন মানুষ, কোথাও বা পথচলতি মানুষও শিবির থেকে চায়ের ভাঁড় নিয়ে গলা ভিজিয়েছেন।
অনেকেই বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দিভাষীর সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। ২০০১ সালের জনগণনার তথ্য বলছে, প্রতি ১০,০০০ জনে ৭১৭ জন হিন্দিভাষী রয়েছেন। দশ বছর পরে সেই সংখ্যাটা আরও বেড়েছে বলেই তৃণমূলের একাংশ মনে করছেন। গত লোকসভার হিসেবে দেখা গিয়েছে, কলকাতায় বিজেপি-র ভোট বেড়েছে। উত্তর কলকাতায় বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ প্রায় সমানে সমানে টক্কর দিয়েছিলেন তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পুরভোটের ক্ষেত্রে সেই হিসেবও তৃণমূলকে চিন্তায় রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ সবের বাইরেও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, ছটপুজোয় কারা পুরস্কার পাবে? দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের তথ্যসংস্কৃতি দফতর বিশ্ববাংলা পুরস্কার দিয়েছে। কলকাতা পুলিশ কালীপুজোয় পুরস্কার দিয়েছে। দেখা গিয়েছে, পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় রয়েছে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম, আবাসনমন্ত্রীর অরূপ বিশ্বাসের পুজো। কালীপুজোর অনেক পুরস্কারই ঘোরাফেরা করেছে মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে। এ দিন সন্ধ্যায় শহরের এক নামী পুজোকর্তার উক্তি, “এ বার কি ববি-অরূপেরা ছটপুজোয় নামবেন? না হলে পুরস্কার যাবে কোথায়!”
ছটপুজোর জেরে এ দিন অবশ্য ভিড়ও দেখেছে মহানগর। পুলিশ সূত্রের খবর, গঙ্গার দিকে শোভাযাত্রার ফলে দুপুর থেকেই ব্রেবোর্ন রোড, স্ট্র্যান্ড রোড-সহ বহু রাস্তায় যানজট হয়। অকল্যান্ড রোড বন্ধ করে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় গাড়ি। বিকেল গড়ানোর পরে বন্দর এলাকা ও উত্তর কলকাতাতেও যানজট তৈরি হয়েছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বিদ্যাসাগর সেতুতে গাড়ির লাইন পড়ে গিয়েছিল। হেস্টিংসের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর সেতু হয়ে ধর্মতলা পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গিয়েছে।
এ দিন দুপুরে মহরমের কয়েকটি শোভাযাত্রার কারণে এ জে সি বসু রোড, মল্লিকবাজার ও পার্ক সার্কাসে যান চলাচল ব্যাহত হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়।