তখনও চলছে লড়াই। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
ছুটির দিনে ক্রেতাদের থিকথিকে ভিড় নেই। তার বদলে গোটা নিউ মার্কেট চত্বর জুড়ে দমকল ও পুলিশের ছোটাছুটি! ঘণ্টা পাঁচেকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও রাত পর্যন্ত পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি। তার ফলে রবিবার সন্ধ্যাতেও ফাঁকা রইল নিউ মার্কেট এলাকা! খাস নিউ মাকের্টে না লাগলেও, এই আগুন ঐতিহ্যবাহী নিউ মাকের্ট ভবনে ১৯৮৫ সালের সেই বিধ্বংসী আগুনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে অনেককেই। ১৩ ডিসেম্বর ’৮৫ সালের সেই আগুনের ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল নিউ মাকের্টের ব়ড় অংশ। পরে অবশ্য অন্য ভাবে তৈরি করা হয় অংশটি।
এই গোটা ছবিটার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নিউ মার্কেট চত্বরের চারতলা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স ‘সিটি মার্ট’। এই বাড়িটিতে আগে লাইটহাউস সিনেমা হলটি ছিল। দমকল জানায়, এ দিন বেলা ১১টা ৫০ মিনিট নাগাদ সিটি মার্টে আগুন লাগে। তাতে ওই দোকানের চারতলাটি ভস্মীভূত হয়েছে। তবে কোনও হতাহতের খবর নেই। আগুন নেভাতে গিয়ে ১২ জন দমকলকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ফের তাঁরা কাজে যোগ দেন। দমকলের অনুমান, শর্ট সার্কিট থেকেই এই আগুন লেগে থাকতে পারে। তবে এই নিয়ে রাত পর্যন্ত পুলিশে কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি দমকলকর্তারা।
দমকল সূত্রের খবর, রবিবার সকাল ১১টা ৫১ মিনিট নাগাদ সিটি মার্ট থেকে তাদের কাছে ফোন যায়। সেখানে বলা হয়েছিল, তিন তলায় আগুন লেগেছে। নিউ মার্কেট থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দমকলের সদর দফতর। কিন্তু ওইটুকু পথ আসতে আসতেই আগুন ছড়িয়ে যায় দোতলা ও চারতলায়। দমকলের এক অফিসারের বক্তব্য, আগুন হয়তো আগেই লেগেছিল। খবর দেরিতে দেওয়ায় তা বড় আকার নেয়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে তিনটি হাইড্রলিক মই-সহ ২৫টি ইঞ্জিন আনা হয়। কিন্তু তাতেও আগুন সামাল দেওয়া যায়নি বেশ কয়েক ঘণ্টা।
দমকল-কর্তাদের একাংশ বলছেন, আগুন লাগার সময় দোকানটি খুলে গেলেও তখনও ক্রেতারা হাজির হননি। আগুন লাগার পরেই কর্মীরা তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসেন। এক দমকলকর্তার মন্তব্য, ‘‘এ দিন বিকেলে আগুন লাগলে বহু লোকই হতাহত হতেন।’’
বেলা বারোটা নাগাদ ওই এলাকাতেই ব্যাগ কিনতে এসেছিলেন খিদিরপুরের বাসিন্দা রাকিব হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎই ওই দোকান থেকে কয়েক জন মহিলা ‘আগুন-আগুন’ বলে চিৎকার করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তার পরেই দেখি, দোকানের তিনতলা থেকে গল গল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।’’ ওই ঘটনা দেখে ছুটে আসেন নিউ মার্কেট এলাকার হকাররাও।
দমকল সূত্রের খবর, দোকানের দোতলা থেকে চারতলায় প্রচুর জামাকাপড়, জুতো, ব্যাগ ডাঁই করা ছিল। সেগুলিতে আগুন লেগে গোটা দোকানটাই কালো ধোঁয়ায় ভরে ছিল। তা দেখে হাইড্রলিক মই নিয়ে এসে বাইরে থেকে জল দেওয়া শুরু হয়। বাইরে থেকে জল দেওয়ার জন্য অন্তত ১২টি পাইপ ব্যবহার করা হয়েছিল। আগুনের পরিস্থিতি নজরে রাখতে কলকাতা পুলিশ এলাকায় উড়ুক্কু যান বা ড্রোন ব্যবহার করা হয়। আশপাশের দোকানগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এলাকার কয়েকটি বাড়িও ফাঁকা করে দেয় পুলিশ। বন্ধ করে দেওয়া হয় নিউ মার্কেট এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগও।
আগুনের পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে এক সময় দমকলের জলও ফুরিয়ে গিয়েছিল। পরে নিউ মার্কেট ও উল্টো দিকের একটি শপিং মলের জলাধার থেকেও জল নেওয়া হয়। জওহরলাল নেহরু রোডের রাস্তা বন্ধ করে মনোহর দাস তড়াগ থেকে পাম্প বসিয়ে পাইপের সাহায্যে সরাসরি জল টানা শুরু হয়। ঘটনার জেরে ব্যাহত হয় যানবাহন চলাচল।
এ দিনের আগুন ছড়িয়ে পড়ার পিছনে ওই দোকানের মালিককেই দায়ী করেছেন দমকলের লোকজন। দমকলের এক কর্তা জানান, ওই দোকানে যথেষ্ট ফায়ার অ্যালার্ম, স্প্রিংকলার কিংবা অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রও ছিল না। তার উপর প্রতিটি তলার ছাদ তৈরি করা হয়েছে প্লাই এবং প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে। রাজ্য দমকলের অধিকর্তা গৌরপ্রসাদ ঘোষ বলেন, ‘‘এত বড় দোকানের জন্য যথেষ্ট অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের বিশেষ দল তদন্ত করবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’’ দমকল মন্ত্রী জাভেদ খানও জানান, অনিয়ম থাকলে মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সিটি মার্টের কর্মীরা একতলা থেকে জিনিসপত্র সরাতে ছোটাছুটি করছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা শপিং মল থেকে জিনিসপত্র বের করে গিয়েছেন।
বিকেল চারটে নাগাদ চৌরঙ্গি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অশোক গুপ্ত-সহ আরও বেশ কয়েক জন সদস্য ঘটনাস্থলে আসেন। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘এই দোকানের মালিককে প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা দেখেই আমরা ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছিলাম। স্বাভাবিক ভাবে দেখে মনে হচ্ছে এটা হয়তো দুর্ঘটনা।’’ এ দিন ঘটনার পরে দোকানের মালিক জন মেন্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি।